রাজনৈতিক সংকটে ফ্রান্স
রাজনৈতিক অস্থিরতায় গভীর সংকটে ফ্রান্স। গত ৪ ডিসেম্বর ফরাসি সংসদের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আস্থা ভোটে পরাজিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাইকেল বার্নিয়ের। এই ঘটনায় নেপোলিয়নের দেশের রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র দুই মাস ২৯ দিন ক্ষমতায় থাকার পর বার্নিয়েরকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে পঞ্চম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর এটি ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী সরকার। প্রধানমন্ত্রীকে হারানোর পর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ’র অবস্থানও এখন অনেকটাই টলমল। বিরোধীরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, নাকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি?
এই সংকট কি পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন জানানোর খেসারত? নাকি রয়েছে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ফ্রান্সের বর্তমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ায় ফ্রান্সের এ ঘটনা ইইউ-তে আর্থিক সংকট আরও তীব্র করবে। ইতিমধ্যেই জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ’ও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। ফলে এক মাসের ব্যবধানে ইইউ-ভুক্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিল।
প্রেসিডেন্টের উপর চাপ বাড়ছে
ফরাসি সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীকে মনোনীত করেন প্রেসিডেন্ট। তবে সংসদীয় আস্থা ভোটে যেকোনো সময় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা যায়। বার্নিয়েরের পতনের পর মাকরঁ’র উপর নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার চাপ পড়েছে। কিন্তু এই কাজ মোটেই সহজ নয়। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ডানপন্থী, বামপন্থী এবং কেন্দ্রীয় দলগুলোর সংখ্যা প্রায় সমান। তাদের মধ্যে সমঝোতা না হলে, স্থায়ী সরকারের অভাবে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি স্থবির হয়ে পড়বে। ১৯৬২ সালের পর এই ধরনের সংকট আবার দেখা দিলেও, এবার পরিস্থিতি আরও জটিল। গত জুনে মাকরঁ একবার আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন। ফলে ২০২৫ সালের জুলাইয়ের আগে আর কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই।
অর্থনৈতিক সংকট ও শাটডাউনের সম্ভাবনা
সরকার পতনের প্রভাব ইতিমধ্যেই ফরাসি শেয়ার বাজারে পড়েছে। বাজেট পাশ না হওয়ায় ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিচ্ছে ফ্রান্সের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো। এ অবস্থায় স্কুল বন্ধ থাকা, বিমান ও রেল পরিষেবা ব্যাহত হওয়া, এবং সরকারি কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্রান্সের সার্বভৌম বন্ডের দাম কমছে এবং ঋণের খরচ বেড়ে গ্রিসের স্তরে পৌঁছেছে।
ফরাসি সংবিধান অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনে বাজেট রোল আউট করতে পারে। কিন্তু এর জন্য জরুরি আইন পাশ করতে হবে, যা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও মস্কোর লাভ
বিশ্লেষকদের মতে, এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় রাশিয়া কৌশলগত সুবিধা পেতে পারে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর উপর চাপ কমেছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকর্নু মন্তব্য করেছেন, এই পরিস্থিতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্য বড় ধাক্কা। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং ফ্রান্স-জার্মানির সরকার পতনের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠছে, এই রাজনৈতিক নাটকীয়তার নেপথ্যে মস্কোর কৌশল কি পরোক্ষভাবে কাজ করছে?
বিকল্প খোঁজার চ্যালেঞ্জ
বার্নিয়েরের জায়গায় নতুন প্রধানমন্ত্রী খুঁজে পাওয়াটা মাকরঁ’র জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক জোট গঠন এবং সংসদের সমর্থন আদায়ে প্রেসিডেন্টকে কৌশলী হতে হবে। বিশেষ ক্ষমতার বলে ২০২৫ সালের বাজেট পাশ করানোর চেষ্টা করতে পারেন তিনি। তবে এই প্রক্রিয়া আইনি জটিলতা এবং রাজনৈতিক খরচ বাড়াবে।
উপসংহার
ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট শুধু দেশটির অর্থনীতিকেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মস্কোর প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট মাকরঁ’কে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ফ্রান্স কি সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, নাকি ইউরোপে নতুন কোনো অস্থিতিশীলতার অধ্যায় শুরু হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।