Thursday, January 30, 2025

নাম বিভ্রাটে জেলবন্দি ললিনী: হ্যাম রেডিয়োর উদ্যোগে ফিরে পেলেন পরিবার

Share

হ্যাম রেডিয়োর উদ্যোগে ফিরে পেলেন পরিবার

নাম এবং ঠিকানার বিভ্রাট জীবনকে কোন দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার একটি মর্মান্তিক উদাহরণ ঝাড়খণ্ডের পলামুর ললিনী চৌধরি। মাত্র একটি অক্ষরের ভুলে, এবং মানসিক সমস্যার কারণে নিজের সঠিক পরিচয় দিতে না পারার জন্য, এই ৬২ বছরের প্রৌঢ়া পশ্চিমবঙ্গের সংশোধনাগারে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত, হ্যাম রেডিয়োর তৎপরতায় পরিবারের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

বিভ্রান্তির সূত্রপাত

২০১৭ সালে, ঝাড়খণ্ডের পলামু জেলার চৈনপুর গ্রামের ললিনী হঠাৎ নিখোঁজ হন। মানসিক রোগে আক্রান্ত ললিনী সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। সে সময় কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটির কাঁটাতার পেরিয়ে ঢুকে পড়ায় তিনি খড়্গপুর রেল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পুলিশের খাতায় তাঁর নাম ভুলক্রমে লেখা হয় ‘নলিনী’। মানসিক অবস্থার কারণে নিজের সঠিক পরিচয় দিতে না পারায়, তাঁর বিরুদ্ধে ‘অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী মামলা হয়। সেই থেকে তিনি মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দি।

পরিবারের সন্ধান না মেলায় জেলেই বন্দি

জেল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ললিনী জামিন পান বছর দুয়েক আগে। তবে পরিবারের ঠিকানা বা যোগাযোগের অভাবে তাঁকে সংশোধনাগারেই থাকতে হয়েছে। সংশোধনাগার থেকে একাধিক বার উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠানো হলেও কোনও উত্তর আসেনি। এই পরিস্থিতিতে সংশোধনাগারের ওয়েলফেয়ার অফিসার অনিরুদ্ধ ঘোষ বিষয়টি ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাব’-এর কাছে নিয়ে যান।

হ্যাম রেডিয়োর উদ্যোগ

হ্যাম রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগবিশ্বাসের নেতৃত্বে শুরু হয় ললিনীর পরিবারের খোঁজ। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে, ললিনীর বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। সেখানে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে, শেষ পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের পলামুতে তাঁর স্বামী লালজি চৌধরির খোঁজ মেলে। স্ত্রীর বেঁচে থাকার খবর পেয়ে তিনি অবাক হয়ে যান।

পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলন

ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ললিনী প্রথমবার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্বামী এবং সন্তানদের দেখে ললিনী আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। একইভাবে, পরিবারের সদস্যরাও কেঁদে ফেলেন। জামিনের শর্ত মেনে ললিনীর মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে পরিবার মেদিনীপুরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

লালজি চৌধরি জানান, নিখোঁজ হওয়ার আগে তাঁর স্ত্রীর মানসিক রোগের চিকিৎসা চলছিল। মাঝে মাঝে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন, কিন্তু এত দূরে গিয়ে এই অবস্থায় পড়বেন, তা কল্পনাও করেননি।

পূর্ব অভিজ্ঞতা

হ্যাম রেডিয়োর মাধ্যমে এমন মানবিক কাজের নজির এই প্রথম নয়। এর আগে, ৪১ বছর ধরে বিনা বিচারে পশ্চিমবঙ্গের দমদম সংশোধনাগারে বন্দি থাকা নেপালের দীপক জোশীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল হ্যাম রেডিয়ো। সেই সময় দীপকের বৃদ্ধা মা ভাবতেও পারেননি যে, তাঁর ছেলে জীবিত এবং বাড়ি ফিরে আসবে।

সতর্কবার্তা এবং প্রস্তাবনা

হ্যাম রেডিয়োর সদস্যরা মনে করেন, গ্রেফতারির সময় ললিনীর ছবি এবং তথ্য যদি সমস্ত রাজ্যে পাঠানো যেত, তাহলে এত দীর্ঘ সময় তাঁকে জেলে কাটাতে হতো না। লালজি জানিয়েছেন, স্ত্রীর নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তিনি স্থানীয় থানায় ডায়েরি করেছিলেন। কিন্তু তথ্য বিনিময়ের অভাবে তা কাজে আসেনি।

শেষ কথা

এই ঘটনা দেখিয়ে দিল যে, মানবিক উদ্যোগ এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার কীভাবে একটি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। ললিনীর মতো আরও অনেক বন্দির জীবন নতুন আশার আলো দেখাতে পারে হ্যাম রেডিয়োর মতো প্রতিষ্ঠানগুলির নিরলস প্রচেষ্টা। তবে, একই সঙ্গে এ-ও স্পষ্ট যে, পুলিশের তথ্যসংগ্রহ প্রক্রিয়ায় আরও উন্নতি আনা প্রয়োজন, যাতে এমন ভুল আর না ঘটে।

Read more

Local News