Sunday, November 30, 2025

‘নাগরিক’ না ‘অদৃশ্য’? এসআইআর-এ নতুন লড়াইয়ে রূপান্তরকামী সমাজ — ভাঙা নথি, পুড়িয়ে দেওয়া পরিচয়, আর প্রশ্ন নাগরিকত্বের

Share

এসআইআর-এ নতুন লড়াইয়ে রূপান্তরকামী সমাজ

দেশে নির্বাচন আসলেই এক নতুন করে গণনার সময়—নাগরিকের অস্তিত্বের প্রমাণপত্র তৈরি হয়, ভোটার তালিকা সংশোধিত হয়। কিন্তু এই নাগরিক প্রক্রিয়া থেকেই যদি বাদ পড়ে যান এক বড় অংশের মানুষ? পশ্চিমবঙ্গের রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাছে ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ (এসআইআর) হয়ে উঠেছে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। যাঁদের নিজের পরিবারই মেনে নেয়নি, তাঁদের কাছ থেকে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া আজ এক নির্মম বিদ্রুপ।


“আমাদের নাম, পরিচয়, ঘর—সবই বদলে গেছে, এখন কোন নথি দেখাব?”

লখনউ থেকে শুরু করে কলকাতা—রাজ্যের নানা প্রান্তে এমন প্রশ্ন তুলছেন অসংখ্য রূপান্তরকামী। কেউ অস্ত্রোপচারের পর লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন, কেউ নাম বদলেছেন, কেউ আবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত। ফলে জন্মশংসাপত্র বা পুরনো নথির নামের সঙ্গে তাঁদের বর্তমান নামের কোনও মিল নেই। কেউ কেউ জানিয়েছেন, তাঁদের বাবা-মা বা ভাইবোন নিজের হাতে জন্ম শংসাপত্র, আধার, স্কুল সার্টিফিকেট পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছেন।

কলকাতার সমাজকর্মী কোয়েল ঘোষ, যিনি ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র ম্যানেজিং ট্রাস্টি, বলেন—

“এদের অনেকেই পারিবারিক নির্যাতনের কারণে ঘর ছেড়েছেন। কারও স্থায়ী ঠিকানা নেই, কারও কাছে পুরনো নথি নেই। তাহলে তাঁদের এনুমারেশন ফর্ম যাবে কোথায়?”

নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় মোট ১১টি প্রমাণপত্র গ্রহণযোগ্য হলেও ‘ট্রান্সজেন্ডার কার্ড’-এর উল্লেখ নেই। ফলে যাঁরা সেই কার্ডের মাধ্যমে পরিচয় দেখাতে চান, তাঁদের আবেদন বাতিল করা হচ্ছে।


“যাঁদের ভোটে সরকার গঠিত, তারাই কি আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেবে?”

ফরিদপুরের সমাজকর্মী অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁরা বহুবার কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, এমনকি চিঠিও পাঠানো হয়েছে—কিন্তু কোনও উত্তর নেই। তাঁর কথায়,

“এসআইআর নিয়ে কেউ আমাদের সঙ্গে বসে কথা বলছে না। প্রতিটি জেলার নির্বাচন আধিকারিকের উচিত ছিল রূপান্তরকামী সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসা।”

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,

“আমাদের ভোটে যারা ক্ষমতায়, তারাই কি আজ আমাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চাইছে?”

অপর্ণা আরও জানান, আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।


আইনের বাস্তব প্রয়োগ কোথায়?

২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক ‘নালসা রায়’-এর পর থেকেই রূপান্তরকামীদের আইনি স্বীকৃতি মিলেছিল। ২০২০ সালে কার্যকর হয় ‘ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস অ্যাক্ট’, যেখানে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নাম ও লিঙ্গ পরিবর্তনের সুযোগ আছে।
কিন্তু বাস্তবে সেই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ও জটিল। অনেকের অভিযোগ, নতুন নামের সার্টিফিকেট মেলেনি, পুরনো ছবির সঙ্গে নথির মিল নেই, আর এসব অমিলের কারণেই তাঁদের ভোটার তালিকায় নাম উঠছে না।

সমাজকর্মী সোহম বসু বলেন—

“কমিশনের বর্তমান এসআইআর প্রক্রিয়া নালসা রায়কেই লঘু করছে। অনেক রূপান্তরকামী দশম শ্রেণির সার্টিফিকেটই পাননি। তা হলে কী করে প্রমাণ দেবেন তাঁরা?”


“পরিবারের পর এ বার রাষ্ট্রও কি ত্যাগ করবে আমাদের?”

চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবলীনা মজুমদার, যিনি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ ছবির পরিচালক, ক্ষোভে বলেন—

“মোদী সরকার আসার পর থেকে আমরা শুধু কাগজ দেখিয়ে চলেছি। আর কত কাগজ দেখাব? আগে পরিবার ত্যাগ করেছে, এবার কি দেশও করবে?”

একই সুর শোনা গেছে রাজ্যের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ-এর কণ্ঠেও। তাঁর প্রশ্ন—

“নির্বাচন কর্মকর্তারা আদৌ জানেন কি রূপান্তরকামীদের সমস্যাটা কী? যদি না জানেন, তাহলে ফর্ম পূরণ বা নাম পরিবর্তনের সহায়তা করবেন কীভাবে?”


রাষ্ট্রের উদাসীনতা আর ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ

রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড বা উন্নয়ন সংস্থা থেকেও কোনও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ আসেনি।
রূপান্তরিত অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—

“রাষ্ট্র রূপান্তরকামীদের জন্য কিছুই করেনি। ভোটের সময়ই হঠাৎ এমন নাগরিক যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অমানবিক। আমাদের নাগরিক জীবনটাই নেই—আমাদের সঙ্গে আচরণ করা হয় পথকুকুরের মতো।”

একজন ক্যুইর সমাজকর্মী জানান, আইনি পদক্ষেপ নিতে অনেকে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, একবার মামলা দায়ের হলে তাঁদের নাম প্রকাশ্যে আসবে, আর তাতেই সমাজে আরও বঞ্চনার আশঙ্কা থাকবে।


শেষ কথা

আজকের প্রশ্নটা শুধু ভোটাধিকার নয়—এটা অস্তিত্বের লড়াই।
যাঁদের পরিবারই স্বীকার করেনি, তাঁদের থেকে রাষ্ট্র নাগরিকত্বের কাগজ চাচ্ছে!
নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই গণতন্ত্রের রক্ষক হয়, তবে তাকে বুঝতে হবে—
মানুষের পরিচয় কাগজে নয়, জীবনে।
আর এই জীবনেই রূপান্তরকামীদের জায়গা দিতে না পারলে, আমরা সকলেই হারাব আমাদের নাগরিক চেতনা।

Read more

Local News