Monday, December 8, 2025

ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে মাথা তুলছে নতুন আশার দেয়াল: গার্ডেনরিচের মৃত্যুপুরীর বর্তমান চিত্র

Share

ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে মাথা তুলছে নতুন আশার দেয়াল!

গার্ডেনরিচের আজ়হার মোল্লা বাগানে ২০২৪ সালের ১৭ মার্চ যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তার ক্ষত আজও পুরোপুরি শুকোয়নি। নির্মীয়মাণ পাঁচতলা বহুতল ভেঙে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ১৩ জন। দীর্ঘ ২১ মাস পেরিয়ে গেলেও সেই স্মৃতি এখনও তাজা। ধ্বংসস্তূপের মাঝেই এখন গড়ে উঠছে নতুন নির্মাণ, তবু মৃতের আর্তনাদ যেন এখনও ভাসমান বাতাসে।

বড় রাস্তা পেরিয়ে সরু গলি ধরে হাঁটলে এই মৃত্যুর স্মৃতি বহন করা ফাঁকা জায়গাটি চোখে পড়ে। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতলগুলোর বেশিরভাগই রংহীন, কোথাও কেবলমাত্র ইটের গাঁথুনি, কোথাও বা অসমাপ্ত প্লাস্টার। মনে হয় যেন কলকাতারই কোনও ভুলে যাওয়া বেরঙিন পাড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি।

এই এলাকা—আজহার মোল্লা গার্ডেন—একসময় ছিল কর্মচঞ্চল। এখন এটি যেন নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরী। বহুতল ভেঙে পড়ার পর পুরসভার কর্মীরা আশপাশের কিছু বিপজ্জনক বাড়িও ভেঙে দেয়। ভেঙে যাওয়া বাড়িগুলোর মধ্যে একটি নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে চার পরিবারের ১২ জনের থাকার কথা। কিন্তু আগের দুর্ঘটনার পর স্থানীয়দের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন—এই নতুন নির্মাণ কি সত্যিই নিরাপদ?

এক মিস্ত্রি জানালেন, এবার ভীত আরও গভীর করা হয়েছে, বাড়ছে পিলার ও বিমের সংখ্যা। কাউন্সিলর শামস ইকবালও নিশ্চিত করলেন, ভাঙা বাড়িগুলোর অনুমোদন এসেছে এবং একটিতে কাজ চলছে। আরও দুটি বাড়িও নিয়ম বহির্ভূত হওয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল; সেগুলির জন্য ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পে আবেদন পাঠানো হয়েছে।

ধ্বংসস্তূপ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইট, কাঠ, ভাঙা পিলার। বহু মানুষ সেই ফাঁকা জায়গায় আবর্জনা ফেলছেন, কেউ গবাদি পশু বেঁধে রাখেন, কেউ জামাকাপড় শুকোন। শিশুদের খেলাধুলা, মুরগির দৌড়ঝাঁপ—সব মিলিয়ে মৃত্যুপুরীই যেন ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে জীবনের স্পর্শ, যদিও শোক এখনও স্পষ্ট।

এই ধসের ভয়াবহতা বহন করে চলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা সাগির আহমেদ। তাঁর পরিবারের চারজন—মা, দুই বোন ও ভাই—সেদিনই মারা যান। সাগির বললেন, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় এখানে ছিল পুকুর। পরে তা ভরাট করে বাড়ি তৈরি হয়। আমার ভাই আপত্তি করেছিল, কিন্তু কেউ শুনল না।’’ তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে—“মা বৃষ্টিতে জল জমলে অসুবিধা করতেন, তাই বাড়িটা একটু উঁচু করিয়েছিলাম। কিন্তু ওর মাথার ওপরেই সব ভেঙে পড়ল।”

সাগিরের বোন আখতারিয়া ও আত্মীয় হায়দার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। আখতারিয়া জানালেন, আজও স্বাভাবিক ঘুম আসে না। হায়দরের হাত আজও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি।

এখন কাজ চলছে কাইজার ইমামদের বাড়িতে। তাঁরা বললেন, ভাড়া বাড়িতে থাকতে থাকতে আজও আতঙ্ক তাদের তাড়া করে। বাড়ি নতুন করে তৈরি হচ্ছে বলেই তাঁদের কিছুটা স্বস্তি।

বেপাক ক্ষতির মুখে পড়েছে ওয়াকিল আলিদের পরিবারও। পাঁচতলা বাড়ি, নয়টি ঘর—সব ধ্বংস। এখন মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতে হচ্ছে। ওয়াকিলের প্রশ্ন—“এখানে কি সব বাড়ি নিয়ম মেনে তৈরি হয়?”

স্থানীয়দের দাবি, প্রায় ৩০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁদের অভিযোগ, নির্মাণের ভুলের দায় তাঁদের কেন বইতে হবে? ধসের পর মালিক, প্রোমোটার, রাজমিস্ত্রিকে গ্রেফতার করা হয়; পুরসভার ইঞ্জিনিয়াররা সাসপেন্ড হন। তদন্ত হয়, বিতর্ক তৈরি হয়—সবই এখন স্তিমিত।

তবে এখনও একটাই আশা—নতুন বাড়ি উঠে গেলে অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে। সেই আশাতেই দিন গুনছেন সাজিদ, ওয়াকিল, সাগিররা।

Read more

Local News