দক্ষিণ কোরিয়াকে
কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত বরাবর রাস্তা এবং রেলপথের পাশে দুটি বৃহৎ পরিখা কেটেছে, যা উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়েছে। এই পরিখা খননের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া কি আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে? এমন প্রশ্ন ঘুরছে কোরীয় উপদ্বীপে, এবং তৈরি হয়েছে যুদ্ধের আশঙ্কা।
কেন এই পরিখা?
সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী যেভাবে পরিখা কেটেছে, তাতে যুদ্ধের প্রস্তুতির এক ধরনের ইঙ্গিতই মেলে। ধারণা করা হচ্ছে, সেনারা এই পরিখার আড়াল থেকে শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। আমেরিকার একটি বেসরকারি সংস্থার উপগ্রহচিত্র থেকে জানা গেছে, এই পরিখাগুলো রাস্তা এবং রেলপথ বরাবর খনন করা হয়েছে। যদিও পিয়ংইয়ং সরকার এই পরিখা খননের কারণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, ফলে এর সঠিক উদ্দেশ্য এখনও অজানা। তবুও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিখাগুলি কোরীয় উপদ্বীপে সম্ভাব্য সংঘাতের প্রাথমিক প্রস্তুতি হতে পারে।
কিম জং উনের পরমাণু নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন তার পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন এবং সেইসঙ্গে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাও চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র আপত্তি রয়েছে। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন বহুবার উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও কিম একের পর এক পরীক্ষা চালিয়ে তার শক্তি প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘চিরশত্রু’ আখ্যা দিয়ে পিয়ংইয়ং জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কোনো ইচ্ছা নেই। এই পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়ার আক্রমণাত্মক নীতির জন্য দুই কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষের আভাস
কিমের ফৌজ সম্প্রতি পশ্চিম সীমান্তের কাইসং এলাকার বেশ কয়েকটি রাস্তা এবং রেললাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করেছে। কিছুদিন পর পূর্ব সীমান্তেও একই ধরনের রাস্তা ধ্বংস করে তারা। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞের পরই সীমান্তে পরিখা খনন করা হয়, যা যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার ইঙ্গিত দেয়। উপগ্রহচিত্রে এই পরিখাগুলোর পাশেই বেশ কয়েকটি যানবাহন এবং মাটি কাটার যন্ত্রও দেখা গিয়েছে, যা পরিখা খননের জন্যই আনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনার সঞ্চার
উত্তর কোরিয়ার এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র বেশ উদ্বিগ্ন। আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গিয়ে জানান, সিউলকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রয়োজনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের জন্যও তারা প্রস্তুত। এদিকে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কও ক্রমশ গভীর হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে কিম জং উন রাশিয়ার সমর্থন পাচ্ছেন। জানা গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করছেন কিম, আর তার বিনিময়ে পুতিনের কাছ থেকে পরমাণু অস্ত্রের উন্নত প্রযুক্তি পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের সম্ভাবনা আরও জটিল করে তুলছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধকৌশল হিসেবে পরিখার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আধুনিক কালে যুদ্ধের ধরন পরিবর্তন হওয়ায় পরিখার ব্যবহার কমে আসে। এখন সেই পুরনো রণকৌশল আবারও ফিরিয়ে আনতে চাইছে উত্তর কোরিয়া। অনেক বিশ্লেষকের মতে, পরিখার পাশে মাটির স্তূপ রেখে কিছু নির্মাণ কাজ চলছে, যা সামরিক বাঙ্কার কিংবা কৌশলগত কাঠামো হতে পারে। এতে করে শত্রু পক্ষের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালানো যাবে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও জোরদার হবে।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার এই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি দেখে বলা যায়, এই উত্তেজনা সহজে প্রশমিত হবে না। কিম জং উন তার আক্রমণাত্মক কৌশল থেকে পিছু হটতে নারাজ, আর যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব কতদূর গড়াবে এবং কোরীয় উপদ্বীপে নতুন কোনো সংঘাতের সূচনা হবে কিনা, তা নিয়ে সারা বিশ্ব এখন দুশ্চিন্তায়।