দক্ষিণেশ্বরে কালীপুজোর মহাভোগে থাকছে কী
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির কেবল একটি পূজার স্থান নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং আধ্যাত্মিকতার এক বিশেষ স্থান হিসেবে বিখ্যাত। ভবতারিণী দেবীর আরাধনার কেন্দ্র হিসেবে কালীপুজোর সময়ে এখানে হাজারো ভক্ত সমাগম হয়। এই মহোৎসব উপলক্ষে বিশেষ ভোগ প্রস্তুত করা হয় যা মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় এবং বিশেষ অতিথিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
এ বছরও মায়ের ভোগের জন্য রয়েছে বিশেষ পদ, যা দিয়ে পূর্ণ হবে ভক্তদের মন এবং মন্দিরের ঐতিহ্য। দক্ষিণেশ্বর মন্দির কর্তৃপক্ষ ও সেবাইতরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে মায়ের জন্য ভোগ প্রস্তুত করেন। এবারে ভোগে থাকছে পাঁচ রকমের পদ, যার মধ্যে রয়েছে নানা রকমের মিষ্টান্ন ও পোলাও থেকে শুরু করে জনপ্রিয় ধোঁকার ডালনা। আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই মহাভোগ প্রস্তুত করা হয় এবং এতে থাকছে কী কী।
কালীপুজোর দিনে বিশেষ ভোগের বন্দোবস্ত
কালীপুজোর দিন মন্দিরে মহাভোগ প্রস্তুত করা হয়, যা মন্দিরের সেবাইতদের হাতে তৈরি হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষের মতে, মা ভবতারিণীকে নিবেদনের জন্য ভাত, ঘি ভাত, পাঁচ রকমের তরকারি, পাঁচ রকমের ভাজা, পাঁচ রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস এবং পাঁচ রকমের মিষ্টান্ন রাখা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে, দর্শনার্থীদের জন্যও বিশেষ ভোগ বিতরণ করা হয়। এটি কেবল পূজার অঙ্গ হিসেবে নয় বরং মন্দিরের একটি বিশেষ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অছি পরিষদের বর্তমান সম্পাদক কুশল চৌধুরী জানিয়েছেন, “মায়ের ভোগের জন্য যে অন্ন এবং মিষ্টান্নগুলি প্রস্তুত করা হয়, তা বহু দিনের পুরনো রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে। পূজার দিন কোনো মাংস ব্যবহার না করেই ভোগ প্রস্তুত করা হয়।” এভাবে দেবীর উদ্দেশ্যে পরিবেশিত হয় প্রাকৃতিক খাদ্য ও মিষ্টান্ন।
অতিথিদের জন্য আলাদা ভোগ
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অতিথি তালিকায় রয়েছেন সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যেমন মুখ্যমন্ত্রী, বিচারপতি এবং অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা। এই অতিথিদের জন্যও মন্দির কর্তৃপক্ষ বিশেষ ভোগ রান্নার ব্যবস্থা করে থাকে। এবারের রান্নার দায়িত্ব পেয়েছেন শুভজিৎ ভট্টাচার্য এবং তাঁর দল, যারা এই বিশেষ রান্নার দায়িত্ব পালন করেন।
শুভজিৎ জানিয়েছেন, “গত বছরের মতোই এ বছরও আমাদের ভোগ রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ অতিথিদের জন্য এমন কিছু পদ রান্না করা হয়, যা দীর্ঘ সময় ধরে রাখার উপযোগী। গত বছরের মেনুতে ছিল ঘি ভাত, আলু ফুলকপির তরকারি, কমলা সন্দেশ, এবং বরিশালের জাউ পিঠা। প্রায় ১২০০ জনের জন্য রান্না করা হয়েছিল, যা ছিল সত্যিই এক বড় চ্যালেঞ্জ।”
এই বছরের বিশেষ ভোগের মেনু
এ বছর মায়ের ভোগে থাকছে বিশেষ সুগন্ধি পোলাও এবং ধোঁকার ডালনা। পোলাও এবং ধোঁকার ডালনা তৈরিতে প্রাচীন রীতি মেনে রান্না করা হবে, যা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই। শুভজিৎ জানালেন, “আমাদের অন্ন ও তরকারি প্রস্তুতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মেনুতে থাকবে বাসন্তী পোলাও এবং ধোঁকার ডালনা। পোলাও তৈরি করার সময় আমি আমার দিদার শেখানো রেসিপিই মেনে চলি।”
বাসন্তী পোলাও রেসিপি
বাসন্তী পোলাও তৈরিতে যে উপকরণ লাগবে:
- সুগন্ধি চাল (গোবিন্দভোগ)
- কাজু-কিশমিশ
- ঘি
- চিনি
- তেজপাতা, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি
প্রণালী: কড়াইয়ে ঘি গরম করে প্রথমে কাজু ভেজে তুলে রাখতে হবে। এরপর সেই কড়াইয়ে সামান্য ঘি রেখে জল দিতে হবে। জল ফুটতে শুরু করলে তেজপাতা, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, এবং সামান্য হলুদ গুঁড়ো দিয়ে চাল মিশিয়ে দিতে হবে। আবার জল ফুটতে শুরু করলে কেওড়া জল এবং গোলাপ জল ছিটিয়ে দিতে হবে। চাল সেদ্ধ হলে ভালো করে মেশানো চাল থেকে জল ঝরিয়ে রেখে দিতে হবে। এরপর একটি বড় পাত্রে গরম ভাত ঢেলে তার উপরে ছড়িয়ে দিতে হবে ভেজে রাখা কাজু-কিশমিশ, চিনি, এবং ঘি। মিনিট পাঁচেক পর ঢেকে রেখে পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত বাসন্তী পোলাও।
ধোঁকার ডালনার প্রণালী
ধোঁকার ডালনার উপকরণ:
- ছোলার ডাল
- আদা বাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা, হিং, গরম মশলা গুঁড়ো
- লঙ্কার গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো
- টক দই
- ঘি ও তেল
প্রণালী: প্রথমে ছোলার ডাল ভিজিয়ে রেখে বাটা হবে। এরপর এই বাটার সঙ্গে আদা বাটা, হিং, গরম মশলা গুঁড়ো, এবং অন্যান্য মশলা মিশিয়ে তেলে পাক দিয়ে নিতে হবে। পাক দেওয়ার পর একটি পাত্রে ঢেলে সেট করে ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। এবার কড়াইতে তেল গরম করে হলুদ, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, এবং লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে কষিয়ে ফেটানো টক দই দিতে হবে। ঝোল ফুটে উঠলে তাতে ধোঁকার টুকরোগুলি দিয়ে দিতে হবে এবং মিনিট খানেক পর ঘি আর গরম মশলা ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে।
দক্ষিণেশ্বরের মহাভোগের ঐতিহ্য
দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজো এবং মহাভোগের রীতিতে রয়েছে প্রাচীন বাঙালি কৃষ্টির ছোঁয়া। এই পূজা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতীক। মায়ের ভোগের জন্য এই বিশেষ রান্না ও সেবার ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রক্ষিত হয়ে আসছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কালীপুজো ও ভোগের এই রীতিনীতি শুধুমাত্র ভক্তদের নয়, সাধারণ দর্শনার্থীদের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়।