তরল সোনা’র দামে দুনিয়া হাঁফাচ্ছে!
জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা নতুন নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেলের দর যেভাবে হু-হু করে বেড়েছে, তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর ভয়াবহ চাপ ফেলছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক সংঘাত, আমদানি ব্যয়, পরিবহণের বাড়তি খরচ— সব মিলিয়ে অনেক উন্নত দেশেই এখন পেট্রল যেন ‘তরল সোনা’। যে কোনও দেশেই তেলের দাম নির্ভর করে কর, শুল্ক, মুদ্রার মান, বাণিজ্যনীতির নিয়ম, প্রতিযোগিতা এবং ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার উপর। ভারতেও দাম বাড়ছে, তবে বিশ্বের বহু প্রান্তে এক লিটার পেট্রলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ৩০০ টাকাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অপরিশোধিত তেলের দর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার মজবুত হওয়ার সম্ভাবনা, যেটা তেলের আমদানি খরচ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির প্রভাবে ডলার শক্তিশালী হলে তেল আরও দুর্মূল্য হয়ে উঠবে। ফলে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়বে স্বাভাবিক ভাবেই।
বিশ্বে যেখানে সবচেয়ে বেশি পেট্রল কিনতে হয়, সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছে হংকং। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে এক লিটার পেট্রলের দাম প্রায় ৩.৪২ মার্কিন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ৩০৪ টাকার সমান। উচ্চ কর, জমির বিপুল মূল্য, স্থানীয় তেল পরিশোধনের সীমিত সুযোগ— এই সব কারণেই হংকংয়ের পেট্রলদর বিশ্বে সর্বোচ্চ।
হংকংয়ের পরেই জায়গা করে নিয়েছে সিঙ্গাপুর। এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশটি সম্পূর্ণভাবে আমদানিকৃত তেলের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন না থাকলেও এখানে রয়েছে বড় পরিশোধনাগারগুলির নেটওয়ার্ক। চলতি বছরের রিপোর্ট বলছে, সিঙ্গাপুরে এক লিটার পেট্রলের দাম প্রায় ২.৯ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৫২ টাকার কাছাকাছি। উচ্চমানের জীবনযাত্রা, সীমিত জমি এবং বড় করের চাপ তেলের দামে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
‘বরফভূমি’ আইসল্যান্ডেও একই ছবি। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে তেল পরিবহণের খরচ আকাশছোঁয়া। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ কর। ফলে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম সেখানে ২.৫২ ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২১৮ টাকার সমান।
ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে নেদারল্যান্ডস অন্যতম ব্যয়বহুল জ্বালানির বাজার। উচ্চ করকাঠামোর কারণে এখানে লিটারপ্রতি পেট্রলের দাম প্রায় ২.৪৪ ডলার, যা ভারতীয় টাকায় ২১৬ টাকার মতো। পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে কার্বন নির্গমন কমাতে ইউরোপীয় দেশগুলির বড় অংশই জ্বালানিতে অতিরিক্ত কর চাপায়, ফলে দাম আরও বেড়ে যায়।
অত্যন্ত ধনী দেশ মোনাকোতেও লিটারপ্রতি দাম ২১২ টাকার কাছাকাছি। আয়করের বোঝা না থাকলেও গাড়ি চালানোর খরচ সেখানে অত্যন্ত চড়া। ডেনমার্কেও একই ছবি— দেশটিতে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম প্রায় ১৯৮ টাকা। ইউরোপের অনেক দেশেই করের পরিমাণ তেলের মূল দামের চেয়ে অনেক বেশি।
মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি, বিশেষত ইরান-ইজরায়েল সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং ওপেকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক তেলের বাজারকে আরও চাপের মুখে ফেলেছে। ইজরায়েলে নিজস্ব তেলের ভাণ্ডার না থাকায় পুরোটাই আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে সেখানে লিটারপ্রতি পেট্রলের দাম প্রায় ১৯২ টাকা।
লিখটেনস্টাইন ও সুইৎজ়ারল্যান্ডেও পরিস্থিতি একই, যেখানে লিটারপ্রতি মূল্য ১৯০ টাকার উপরে। আয়ারল্যান্ডেও করের চাপের কারণে দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭৪ টাকা।
বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারের এই উথালপাতালে প্রভাব পড়ছে জনজীবন থেকে শিল্প— সর্বত্র। ভবিষ্যতে ভূ-রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয় তার উপরই নির্ভর করছে ‘তরল সোনা’র এই জ্বালা কমবে, নাকি আরও বাড়বে।

