Friday, February 7, 2025

ট্যাব দুর্নীতি: কীভাবে গড়ে উঠল জালিয়াতি চক্র এবং রাজ্যের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

Share

ট্যাব দুর্নীতি

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ট্যাব দুর্নীতি কাণ্ড। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “তরুণের স্বপ্ন” প্রকল্পের আওতায় রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়াদের ট্যাব কেনার জন্য বরাদ্দ অর্থের অনিয়ম উদঘাটিত হওয়ায় প্রশাসনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটি চালুর মূল উদ্দেশ্য ছিল, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সহায়তা করতে তাদের অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা জমা করা। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসছে, এই অর্থ যথাযথ অ্যাকাউন্টে পৌঁছায়নি বরং প্রতারকচক্রের হাতে চলে গেছে।

গোড়ায় সমস্যা: দুর্নীতির ভিত্তি এবং কীভাবে ঘটল প্রতারণা

তদন্তে দেখা গেছে, কিছু অসাধু সাইবার ক্যাফের মালিক ও স্থানীয় প্রতারকচক্র স্কুলগুলোর লগ-ইন ক্রেডেনশিয়াল ব্যবহার করে গোপনে পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পরিবর্তন এনে এই টাকা অন্যত্র সরিয়ে দিচ্ছিল। সাধারণত স্থানীয় সাইবার ক্যাফের সাথে স্কুলের যোগাযোগ থাকায় এই প্রতারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লগ-ইন তথ্য পাওয়া সহজ হয়েছে। সাইবার ক্যাফে থেকে অনলাইনে লগ-ইন করে শিক্ষা দফতরের তথ্য ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং আইএফএসসি কোড বদলে দেওয়া হয়। এভাবেই বেআইনি পদ্ধতিতে প্রায় দুই হাজার পড়ুয়ার ট্যাব কেনার টাকা গায়েব করা হয়েছে বলে ধারণা করছে তদন্তকারীরা।

অভিযানে ধরা পড়েছে কৃষক, শ্রমিক এবং গৃহশিক্ষকেরা

বিভিন্ন পেশার মানুষ এই প্রতারণা চক্রে জড়িত বলে জানা গেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পূর্ব বর্ধমান, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক, চা-বাগানের শ্রমিক, এবং এমনকি গৃহশিক্ষকেরাও রয়েছেন। তাদের সকলেরই পেশাগত পরিচয় আলাদা হলেও তারা নিজেদের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয় কাজে লাগিয়েই তারা প্রতারণা করতেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

বহিরাগত প্রতারকদের যোগসূত্র: ভিন রাজ্যের সাইবার চক্রের সম্ভাবনা

তদন্তে আরও প্রকাশ পেয়েছে যে, এই প্রতারণা শুধু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিহারের কিষানগঞ্জ, মধ্যপ্রদেশের রায়পুর সহ একাধিক রাজ্যে এই প্রতারণা চক্রের সম্ভাব্য নেটওয়ার্ক রয়েছে। স্থানীয় তদন্তকারীদের মতে, আইএফএসসি কোড বদলের ক্ষেত্রে এই ভিন রাজ্যের প্রতারকদের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের বাইরেও একই রকম প্রতারণার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিশদে তদন্তের প্রয়োজনীয়তা বাড়াচ্ছে।

তদন্ত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ: মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা

ট্যাব দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাজ্যের পুলিশ মহাপরিচালক রাজীব কুমার এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। ইতিমধ্যেই বর্ধমান, মালদহ, এবং দিনাজপুর থেকে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতারণা চক্রের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে বিভিন্ন সাইবার ক্যাফের মালিকদের কাছ থেকে ল্যাপটপ ও প্রয়োজনীয় নথি উদ্ধার করা হয়েছে।

কলকাতা পুলিশের অনুসন্ধান ও রাজ্যের বিভিন্ন থানায় অভিযোগ জমা

কলকাতা পুলিশও এই ট্যাব দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ করেছে। যাদবপুর এবং ঠাকুরপুকুর থানার মতো অঞ্চলে প্রথমে অভিযোগ জমা পড়লেও বর্তমানে মানিকতলা, বেনিয়াপুকুর সহ আরও বিভিন্ন থানায় অভিযোগ জমা হচ্ছে। শুধু কলকাতায় ছয়টি থানায় ইতিমধ্যেই অভিযোগ জমা পড়েছে এবং এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

সম্ভাব্য শিক্ষা দফতরের গাফিলতি এবং প্রশাসনিক অসন্তোষ

শিক্ষা দফতরের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন যেমন বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি এবং শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ অভিযোগ করেছে যে শিক্ষা ও অর্থ দফতরের অসতর্কতা ও ব্যবস্থাপনা গাফিলতির জন্যই এই ধরনের দুর্নীতি ঘটেছে। সংগঠনগুলোর নেতারা যথাযথ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এবং শিক্ষা দফতরের সঠিক নজরদারির অভাবকেই দায়ী করেছেন।

সমাজে প্রভাব: দুর্নীতি রোধে প্রয়োজন প্রশাসনিক দৃঢ়তা ও সতর্কতা

এই ধরনের জালিয়াতি কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং সামাজিকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ এই অর্থ সঠিকভাবে প্রাপকদের হাতে না পৌঁছে প্রতারকদের হাতে চলে যাওয়ায় তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। প্রশাসনিক তদারকি বাড়ানো না হলে এই ধরনের প্রতারণা ভবিষ্যতেও চালু থাকার সম্ভাবনা। শিক্ষাক্ষেত্রে যে কোনও ধরনের আর্থিক সহায়তা বিতরণে প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করা উচিত।

নিষ্কর্ষ

ট্যাব দুর্নীতি কাণ্ড রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা ও অসতর্কতার এক বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সামনে এসেছে। প্রতারণা চক্রে সাধারণ মানুষ, যেমন কৃষক, শ্রমিক এবং গৃহশিক্ষকদের যুক্ত থাকা এবং রাজ্যের বাইরে প্রতারণা চক্রের অস্তিত্ব আরও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, এবং সাধারণ মানুষ আশা করছেন এই দুর্নীতির চক্র ভেঙে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই দুর্নীতির প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দেয় যে প্রশাসনিক নজরদারি ও সতর্কতা ছাড়া যেকোনো সুশাসন ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি হওয়া প্রায় অসম্ভব।

Read more

Local News