জতুগৃহে পরিণত গোয়ার নৈশক্লাব!
গান, আলো আর নাচে মেতে থাকা শনিবার রাত এক মুহূর্তে দুঃস্বপ্নে পরিণত হল গোয়ার আরপোরার জনপ্রিয় নৈশক্লাব ‘বার্চ বাই রোমিয়ো লেন’-এ। সেদিন রাতেই সেখানে ঘটে গেল এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যাতে প্রাণ হারালেন মোট ২৫ জন। মৃতদের মধ্যে ২০ জনই ক্লাবের কর্মী, বাকিরা ভিন্রাজ্য থেকে আসা পর্যটক। ইতিমধ্যেই সকলের দেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা রাজ্যে, এবং শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা নৈশক্লাব পরিচালনার গাফিলতি নিয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও তদন্তকারীদের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডের সময় ক্লাবের ভিতর প্রায় ১০০ জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন। আগুন লাগতেই সর্বত্র হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, আর বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেতে অনেকেই ছুটে যান বেসমেন্টের দিকে, যেখানে ছিল রান্নার জায়গা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মৃত ২৫ জনের মধ্যে ২৩ জনের দেহে দগ্ধ হওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন নেই। তাঁদের শক্তিশালী অনুমান—এই ২৩ জন ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়েই প্রাণ হারান। মাত্র দু’জনের দেহ আগুনে ঝলসে যায়।
এটাও জানা যাচ্ছে, নৈশক্লাবটিতে প্রবেশ ও বেরোনোর জন্য ছিল মাত্র দু’টি দরজা। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সেই দু’টি পথই কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ফলে যাঁরা বেসমেন্টে নেমেছিলেন, তাঁদের পক্ষে আর উপরে ওঠা সম্ভব হয়নি। বদ্ধ পরিবেশে ঘন ধোঁয়া তৈরি হওয়ায় মুহূর্তেই নিঃশ্বাস আটকে আসে তাঁদের।
তদন্তকারীদের একাংশের মতে, ক্লাবের ভিতরে থাকা আসবাবপত্রই বিপদ বাড়িয়ে দেয়। বেশিরভাগ চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে সাজসজ্জা পর্যন্ত সবই ছিল কাঠের। কাঠের তৈরি অভ্যন্তরীণ কাঠামো আগুনকে ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়—যেন জতুগৃহে পরিণত হয় গোটা নৈশক্লাব।
এই ঘটনার পরে গোয়া সরকারের পক্ষেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাজ্য কর্তৃপক্ষ তিন জন সরকারি আধিকারিককে সাসপেন্ড করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—প্রয়োজনীয় অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে ক্লাবটির কার্যক্রম চালু করার ছাড়পত্র তাঁরা দিয়েছিলেন। সাসপেন্ড হওয়া তিন আধিকারিকের মধ্যে রয়েছেন পঞ্চায়েত দফতরের ডিরেক্টর সিদ্ধি তুলসী হরলঙ্কার, গোয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সচিব শমিলা মন্টেরিয়ো এবং আরপোরা পঞ্চায়েতের সচিব রঘুবীর বাগকর।
এদিকে দমকল বিভাগের প্রাথমিক তদন্ত বলছে—নৈশক্লাবটির কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়পত্র (NOC) ছিল না। নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। প্রয়োজনীয় ফায়ার এক্সিট, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম—কিছুই ছিল যথাযথ নয়। দমকল আধিকারিক নীতিন রাইকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, ক্লাবটি কোনও ভাবেই নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ করছিল না। আগুনের কারণ হিসেবে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকলেও অন্য কারণও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এমন আতঙ্কের মধ্যেই নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন কাজাখস্তানের নৃত্যশিল্পী ক্রিস্টিনা। অগ্নিকাণ্ডের মুহূর্তে তিনি মঞ্চে নাচছিলেন। তাঁর কথায়, “হঠাৎ চিৎকার আর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ক্লাবের এক কর্মীর সাহায্যে কোনও রকমে বেরিয়ে এসে প্রাণে বাঁচি।” ক্রিস্টিনা জানান, অনেক পর্যটক আগুন লাগার পরেই বাইরে বেরোতে পারলেও যাঁরা বেসমেন্টে নেমেছিলেন, তাঁদের আর বাঁচানো যায়নি।
গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাওন্ত জানিয়েছেন, এই ঘটনায় যাঁরা দায়ী, কাউকে রেয়াত করা হবে না। পুলিশ ইতিমধ্যেই ক্লাবের জেনারেল ম্যানেজারকে গ্রেফতার করেছে। তবে ক্লাবের মালিক এখনও অধরা। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
এক রাতের আনন্দ কী ভাবে প্রাণঘাতী ফাঁদে পরিণত হল—তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বাড়ছে দেশজুড়ে। প্রশ্ন উঠছে, অনুমতিহীন নৈশক্লাব কী ভাবে দীর্ঘদিন চলল? কী ভাবে এত বড় গাফিলতি নজর এড়াল? তদন্ত চলছে, তবে পরিবারের জন্য শোক আর শূন্যতা দিয়েই শেষ হচ্ছে এই রাতের হিসেব।

