চীনের ‘অক্টোপাস জাল’ !
চীন একের পর এক আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সামনে এনে গোটা বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে। কখনও ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, কখনও স্টেলথ ডুবোজাহাজ শনাক্তকরণের প্রযুক্তি— প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেদের সামরিক শক্তিকে আরও উন্নত করছে বেইজিং। এবার তাদের নতুন সংযোজন দূরপাল্লার একটি অত্যাধুনিক রাডার, যা হাইপারসনিক (শব্দের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্রকেও চিহ্নিত করতে সক্ষম বলে দাবি করেছে চীনের প্রতিরক্ষা বাহিনী।
দূরপাল্লার রাডারের শক্তিশালী নজরদারি
চলতি বছরের জানুয়ারিতে চীনের সরকারি গণমাধ্যমে এই রাডার প্রযুক্তির প্রথম ঝলক প্রকাশ করা হয়। দাবি করা হয়, এই বিশেষ রাডার অন্তত হাজার মাইল দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে পারবে। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতেরও উদ্বেগ বেড়েছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রযুক্তি চীনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং শত্রুপক্ষের হামলা প্রতিহত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
শি জিনপিংয়ের সামরিক অভিবাদন এবং নতুন প্রযুক্তির প্রদর্শনী
চীনের চন্দ্র নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটির সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA)-এর উদ্দেশে ভাষণ দেন। ওই অনুষ্ঠানে সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের দিক তুলে ধরা হয় এবং নতুন রাডার ব্যবস্থার কার্যকারিতা দেখানো হয়। শি জিনপিংয়ের দাবি, এই রাডার সীমান্তের ওপার থেকে আসা যে কোনো শত্রু অস্ত্র সনাক্ত করতে পারবে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীকে তাৎক্ষণিক সতর্কবার্তা দেবে।
গোপন ভিডিও ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার উদ্বেগ
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে PLA একটি গোপন ভিডিও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কার্যালয়ে পাঠায়, যেখানে নতুন রাডার ব্যবস্থার কার্যকারিতা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এই প্রযুক্তির ফলে চীনের স্থল, নৌ, বিমান ও মহাকাশ বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি দেয়নি চীনা সরকার।
কীভাবে কাজ করে এই রাডার?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অত্যাধুনিক রাডার একটি বিশাল কাঠামোর সমন্বয়ে তৈরি, যার উচ্চতা ছয়তলা ভবনের সমান। এতে অসংখ্য অ্যান্টেনা এবং একটি বিশেষ আকৃতির (অষ্টাভুজাকার) অ্যারে রয়েছে, যা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ সনাক্ত করতে সাহায্য করে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ইতিমধ্যেই রাডারের কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছে।
PLA-র শক্তি বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জিয়ামুসি প্রদেশে PLA এই রাডার স্টেশন স্থাপন করেছে। চীনা সেনাবাহিনীর সাবেক প্রশিক্ষক ঝংপিং বলেছেন, “এই রাডারের মাধ্যমে PLA কৌশলগতভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে। এটি কয়েক হাজার কিলোমিটার দূর থেকে যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র সনাক্ত করতে সক্ষম।”
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় গেম-চেঞ্জার
বর্তমান আধুনিক যুদ্ধে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, কারণ এদের গতির কারণে সাধারণ রাডার ব্যবস্থায় এগুলো ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে PLA-র দাবি, নতুন রাডার এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। ফলে শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র মাঝ আকাশেই ধ্বংস করা সহজ হবে।
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
চীনের এই উন্নত প্রযুক্তি ভারত ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে ‘ভোরোনেজ’ নামে একটি দূরপাল্লার রাডার কেনার পরিকল্পনা করছে, যা চীনের নতুন রাডারের পাল্টা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে। ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের এই চুক্তি সম্পন্ন হতে পারে।
রাশিয়ার ‘ভোরোনেজ’ রাডার: ভারতের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা অস্ত্র
‘ভোরোনেজ’ রাডার ব্যবস্থাটি রাশিয়ার ‘আলমাজ-অ্যান্টে কর্পোরেশন’ তৈরি করেছে এবং এটি রুশ সেনার অন্যতম প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর পাল্লা প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার এবং এটি একসঙ্গে ৫০০-এর বেশি লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করতে পারে। এই রাডার বিশেষভাবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্টেলথ যুদ্ধবিমান সনাক্তকরণের জন্য কার্যকর।
ভারতের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং মস্কো সফর করেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এই রাডার চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই চুক্তির অন্তর্গত বেশিরভাগ যন্ত্রাংশ ভারতেই তৈরি করা হবে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের আওতায়।
চীন-ভারত প্রতিরক্ষা প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে
চীন তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য একের পর এক প্রযুক্তিগত উন্নতি করছে, যা ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, ভারতও নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে নতুন প্রযুক্তি আনতে তৎপর। ফলে আগামী দিনে এশিয়া অঞ্চলে প্রতিরক্ষা প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
শেষ কথা: চীনের ‘অক্টোপাস জাল’ সদৃশ নতুন রাডার ব্যবস্থা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। এটি ভবিষ্যতে সামরিক শক্তির ভারসাম্যে কী পরিবর্তন আনবে, তা সময়ই বলে দেবে।
মাটির নীচ থেকে গর্জনের শব্দ! ভূমিকম্পের নতুন অভিজ্ঞতায় আতঙ্কিত দিল্লিবাসী— কেন হল এমন?