চড়ুই নিধন যজ্ঞ
চিনের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে যা মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক একটি হলো ১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া ‘গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেন’। চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই অভিযান প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের এক ভুল পদক্ষেপের করুণ পরিণতির উদাহরণ। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল চিন থেকে চড়ুই পাখি সম্পূর্ণ নির্মূল করা। কিন্তু ফলাফল ছিল ভিন্ন—পুরো দেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে, যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রাণ হারান।
মাওয়ের নির্দেশ আর চড়ুই নিধন অভিযান
১৯৫৮ সালে মাও চিনকে শিল্পোন্নত দেশে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ ঘোষণা করেন। এর অংশ হিসেবে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে তিনি চড়ুই নিধনের সিদ্ধান্ত নেন। চড়ুই প্রতি বছর কয়েক কেজি শস্য খেয়ে ফেলে—এই রিপোর্টের ভিত্তিতে মাও ধারণা করেন, পাখিগুলোকে নির্মূল করলে বিপুল পরিমাণ শস্য রক্ষা পাবে। এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিজ পণ্য রফতানি করে আমেরিকার প্রতিযোগী হয়ে উঠবে।
চড়ুই নিধনের প্রক্রিয়া
মাওয়ের নির্দেশে পুরো দেশ চড়ুই নিধনের কাজে লেগে যায়। স্কুলের ছাত্রছাত্রী, সরকারি কর্মচারী, এমনকি কারখানার শ্রমিকরাও চড়ুই হত্যায় অংশ নেন। পাখির বাসা ধ্বংস করা, ডিম ভেঙে দেওয়া, তীব্র আওয়াজ তৈরি করে পাখিদের ক্লান্ত করে মাটিতে ফেলে হত্যা—এই সব পদ্ধতিতে অসংখ্য চড়ুই মারা হয়। এমনকি গুলি এবং বিষ প্রয়োগ করেও পাখি নিধন চালানো হয়।
পরিণতিতে প্রকৃতির প্রতিশোধ
চড়ুই নিধনের পর দেখা গেল, এই পাখি শুধু শস্য নয়, ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড়ও খায়। পাখির অনুপস্থিতিতে পোকামাকড়ের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়, যা কৃষিজমির আরও বড় ক্ষতি করে। একই সময়ে খরার কবলে পড়ে দেশ এবং পঙ্গপালের আক্রমণে মাঠের পর মাঠ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কীটনাশক প্রয়োগ করেও সমস্যা সামাল দেওয়া যায়নি।
দুর্ভিক্ষ আর মানুষের দুর্ভোগ
১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত চিনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলে। লাখ লাখ পরিবার খাবারের জন্য মাটি খেতে বাধ্য হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই দুর্ভিক্ষে দেড় কোটি মানুষ মারা যায়। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি পর্যন্ত হতে পারে। শুধু খাবারের অভাবই নয়, খাদ্যের জন্য মানুষে মানুষে লড়াই এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে।
শিক্ষা ও ভবিষ্যতের প্রভাব
চড়ুই নিধনের ফলে চিনা জনগণের স্বাস্থ্যের উপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, এবং ক্যানসারের মতো রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঘটনা আজও পরিবেশ আর প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বের এক নির্মম শিক্ষা দিয়ে যায়।
চিনের এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বিশ্বকে বুঝতে হবে যে, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই নয়, বরং তার সঙ্গে সহাবস্থানই মানুষের টিকে থাকার চাবিকাঠি।