Saturday, February 8, 2025

গৌতম গম্ভীরের কোচিং থেকে ভারতীয় ক্রিকেটে উত্তাল সময়: বিতর্কের কেন্দ্রে কোচ গম্ভীরের সিদ্ধান্ত

Share

গৌতম গম্ভীরের কোচিং থেকে ভারতীয় ক্রিকেটে উত্তাল সময়

ভারতীয় ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে গৌতম গম্ভীরের কোচিং কৌশল ও নেতৃত্ব। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতীয় দলের টেস্ট সিরিজে পরাজয় এবং আরও একাধিক সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। কোচ হওয়ার আগে ভারতীয় ক্রিকেটে বিভিন্ন ধরনের প্রথাগত নিয়ম ভাঙার ইঙ্গিত দিয়ে নতুন দিশা দেখানোর অঙ্গীকার করেছিলেন গম্ভীর। তবে তার সেই অঙ্গীকার কতটা সফল হলো, সেটাই এখন প্রশ্নের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গম্ভীরের শর্তাবলি ও বিসিসিআই-এর ছাড়পত্র

কোচ হওয়ার পরেই গম্ভীর বিসিসিআই-এর কাছে পাঁচটি স্পষ্ট শর্ত দেন, যা ক্রিকেট বোর্ডকে অনেকটা বাধ্য করেছে। এই শর্তগুলির মধ্যে ছিল দলে কেবল তার পছন্দসই সহকারী কোচ নিয়োগ, ক্রিকেট সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় তার তত্ত্বাবধানে থাকা, এবং ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলির মতো তারকাদের দায়িত্ব বহাল রাখার শর্ত। বোর্ড অনেক শর্তই মেনে নিলেও ফলাফল ঠিক প্রত্যাশিত হয়নি। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে লজ্জাজনক পরাজয় ভারতীয় সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ভারতের ঘরের মাঠে ১২ বছর পর এমন পরাজয় ভারতীয় দলের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।

ঘূর্ণি পিচ এবং ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা

গম্ভীরের অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল ভারতের মাটিতে ঘূর্ণি পিচ তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া। ঘরের মাঠে এই ধরনের পিচ প্রস্তুত করার ফলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের স্পিন সামলানোর দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। পুণে ও মুম্বাই টেস্টে ঘূর্ণি পিচ ভারতীয় দলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বোর্ডের অনেক কর্তারাও এই সিদ্ধান্তে চমকে ওঠেন। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, দলের ব্যাটিং অর্ডার নিয়েও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গম্ভীর, যা দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শুভমন গিলের অনুপস্থিতিতে বিরাট কোহলিকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো এবং সরফরাজকে জাডেজার পরে নামানোর মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে দল অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে যায়।

কোচ গম্ভীরের ভূমিকা ও ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত

গম্ভীরের দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতীয় দল শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে হারালেও, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি টেস্টেই পরাজিত হওয়ায় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোচ হিসেবে তিনি দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মার সিদ্ধান্তে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষত বেঙ্গালুরু টেস্টে টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত ভারতীয় দলের জন্য এক বিশাল ভুল প্রমাণিত হয়, এবং এতে রোহিত শর্মা পরবর্তীতে নিজেই স্বীকার করেন যে তিনি পিচ বুঝতে ভুল করেছিলেন।

গম্ভীরের অনভিজ্ঞতা এবং বিদেশি সহকারীদের প্রভাব

গম্ভীরের সহকারীদের মধ্যে ছিলেন রায়ান টেন দুশখতে এবং মর্নি মর্কেল, যারা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিত নন। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ লক্ষ্মীরতন শুক্ল মনে করেন, বিদেশি কোচদের চেয়ে ভারতীয় কোচই ভারতীয় ক্রিকেটারদের উন্নত করতে বেশি সক্ষম। এমনকি অতীতের ভারতীয় কোচ রাহুল দ্রাবিড় নিজেও ভারতীয় ক্রিকেটের আভ্যন্তরীণ দিকগুলো খুব ভালভাবে বুঝতেন, যা গম্ভীরের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

প্যাডি আপটনের অভিজ্ঞতা: গম্ভীরের মানসিকতা

গম্ভীরের মানসিক অবস্থার ব্যাপারে প্যাডি আপটনের অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মতে, গম্ভীর মানসিকভাবে অত্যন্ত নেতিবাচক এবং সঙ্কুচিত মনোভাবের অধিকারী। তিনি আরও বলেন, “নিরাপত্তাহীনতা এবং সন্দেহ গম্ভীরের মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করত, যা তাকে একজন নেতিবাচক এবং নৈরাশ্যবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।” গম্ভীরের ব্যক্তিত্বের এই দিক তার কোচিংয়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারতীয় ক্রিকেটে তারকা কোচের সমস্যা এবং পূর্ববর্তী উদাহরণ

ভারতীয় ক্রিকেটে তারকা কোচ নিয়ে সমস্যা আগে থেকেই ছিল। গ্রেগ চ্যাপেলের জমানায় অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব এবং অনিল কুম্বলের সঙ্গে বিরাট কোহলির মতবিরোধ ভারতীয় ক্রিকেটে আলোচিত বিষয় ছিল। চ্যাপেলের আমলে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তারকাদের উপেক্ষা করার প্রবণতা এবং কুম্বলের কড়া শাসনের বিরোধিতা ছিল তার উদাহরণ। গম্ভীরের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই একই ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যা ভারতীয় দলের জন্য অশুভ সংকেত হতে পারে।

গম্ভীরের তারকা খ্যাতির অভাব

ক্রিকেটার হিসেবে গম্ভীর কখনোই সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড় বা মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো তারকা হতে পারেননি। তার ওপেনিং পার্টনার বীরেন্দ্র সহবাগ বা বর্তমান কোচ দ্রাবিড়ের মতো তারকা কোচ হওয়ার জন্য তার অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি তিনি রবি শাস্ত্রীর মতো ধারাভাষ্যকার হিসেবেও ক্রিকেটের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন না, বরং তিনি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ফলে তার পক্ষে তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করা কতটা সহজ, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

গম্ভীরের নেতৃত্বে নতুন দিশা, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতীয় ক্রিকেটের কোচ হিসাবে দায়িত্ব পান গম্ভীর। আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টর থাকাকালীন তার দলের সাফল্য তাকে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নির্বাচিত করার পথ সহজ করে দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় দলের কোচ হিসেবে তিনি কতটা সফল, তা নিয়ে বিসিসিআই-এর মধ্যে এখনও সন্দেহ রয়েছে। তিনি শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে হারালেও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বিপর্যয়ের কারণে তার কোচিং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই, সামনের দিনগুলোতে গম্ভীরের কোচিং ভবিষ্যত অনিশ্চিত।

গৌতম গম্ভীর ভারতীয় ক্রিকেটে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। তবে তার পদ্ধতি এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গাফিলতি এবং অভিজ্ঞতার অভাব ভারতীয় ক্রিকেটকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে।

Read more

Local News