কলকাতায় সুরের উৎসব
সঙ্গীতের কোনও সীমানা নেই। সুরের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না কোনো দেশের সীমান্ত, কোনো জাতির পরিচয়। সুর নিজেই পৃথিবীকে একত্রিত করার শক্তি রাখে, এবং তার যাত্রা কখনো থামে না। কলকাতার অন্যতম বড় উৎসব ‘সুর জাহান’ প্রতিটি বছর এই সার্বজনীন সুরের সংযোগ ঘটায়, যেখানে বিশ্বের নানা কোণে উৎপন্ন সুর একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে এক অপূর্ব সঙ্গীত আখ্যান। এবার ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, গল্ফগ্রিন সেন্ট্রাল পার্কে অনুষ্ঠিত হবে এই বিশেষ উৎসব, যা আয়োজিত করছে বাংলানাটক ডট কম।
বিশ্বসঙ্গীত বা ‘ওয়ার্ল্ড মিউজ়িক’ সঙ্গীতের এক বিশেষ জঁর যা নব্বইয়ের দশক থেকে সমগ্র পৃথিবীতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। সঙ্গীততত্ত্ববিদেরা মনে করেন, ‘বিশ্বায়ন’ ধারণার সূত্রপাত হয়েছিল সুরের মধ্য দিয়ে। এক অঞ্চলের সুর যদি অন্য অঞ্চলে পৌঁছে, এবং সেখানে তার সঙ্গে মিলেমিশে নতুন সুরের জন্ম হয়, তবে সেটাই বাস্তবে বিশ্বায়নের আদল। কলকাতা, যেখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যের মিশেল, এই এক উৎসবের মাধ্যমে পৃথিবীর সুরকে বরণ করে নেয় এবং সবার জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
২০১১ সালে সঙ্গীত উৎসবের যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘সুফি সূত্র’ নামক একটি আয়োজনের মাধ্যমে, যা পরে ২০১৫ সালে ‘সুর জাহান’ নাম নিয়েছিল। বাংলানাটক ডট কম-এর মুখপাত্র অমিতাভ ভট্টাচার্য জানান, এই নামবদল এক বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রতীক ছিল। সুফি সঙ্গীত একসময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী এক সুরের ধারা তৈরি করেছিল, কিন্তু একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিশ্বের নানা পরিবর্তনের সঙ্গে তা আর ধর্মীয় সীমারেখায় আটকে থাকতে চায়নি। ‘সুর জাহান’ নামটি বহুত্ববাদী চেতনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে প্রতিটি সুর, প্রতিটি সংস্কৃতি একসঙ্গে মিশে যায়।
এবারের ‘সুর জাহান’ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে আসছে চারটি দেশ: আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন এবং ভারত। সুইডেনের আলে মোলার, যিনি বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে একটি পরিচিত নাম, ২০১৭ ও ২০২০ সালে এই উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন এবং এবার আসছেন ‘আলে মোলার ট্রায়ো’ নিয়ে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান লোকসঙ্গীতের সঙ্গে এই দলের পরিবেশনা যেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সুরের মেলবন্ধন। গ্র্যামি পুরস্কৃত মোলার নিজে বাজান ম্যান্ডোলিন, এবং তিনি ও তার সঙ্গীরা বাজান অ্যাকোর্ডিয়ান, ফ্লুট বা ক্লোহর্নের মতো অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র।
নেদারল্যান্ডসের ‘ফোককর্ন’ ব্যান্ডটি ১৯৭৩ সাল থেকে শিকড়ের সুরের সন্ধান করছে। এই ব্যান্ডটি ঐতিহ্যগত নেদারল্যান্ডসের লোকসঙ্গীতকে পুনরুদ্ধারের কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে, আইসল্যান্ডের ‘উমব্রা আঁসেম্বল’ ব্যান্ডটি ২০১৪ সালে গঠিত হলেও ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতপ্রেমীদের মন জিতে নিয়েছে। তাদের সঙ্গীতের মধ্যে সুফি প্রভাব স্পষ্ট, যা উত্তর ইউরোপের মধ্যযুগীয় সঙ্গীতের সাথে মিলিত হয়ে একটি নতুন রূপ ধারণ করেছে।
এবারের ‘সুর জাহান’ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হবে সলিল চৌধুরীর শতবর্ষ উদযাপন। মহীতোষ তাপস তালুকদারের পরিচালনায় ‘সুরবন্ধন’ গোষ্ঠী সলিল চৌধুরী সঙ্গীতের উপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে। বাংলার সঙ্গীতের মেলবন্ধন তুলে ধরবে ‘ফোকস অফ বেঙ্গল’। এই সংগীতের অনুষ্ঠানে চিরায়ত লোকসঙ্গীতের সঙ্গে সমসাময়িক সঙ্গীতের এক নতুন রূপ দেখা যাবে, যেখানে দেবোময় দাস, মনস্বিতা ঠাকুর, জয়শঙ্কর চৌধুরী ও প্রাণেশ সোম থাকবেন।
এছাড়া, বাংলার বাউল-ফকিরদের গানও ‘সুর জাহান’-এর নিয়মিত অংশ। এবারে কাঙাল খ্যাপা, নিমাই খ্যাপা এবং অর্জুন খ্যাপা আসবেন রাজস্থানের বাউল সুর নিয়ে। পশ্চিম রাজস্থানের মরুভূমি থেকে কসম খান লঙ্গা এবং তাঁর সম্প্রদায়, ওড়িশার কোরাপুট অঞ্চলের দুরুয়া জনজাতির শিল্পীরা তাদের নৃত্য ও সঙ্গীত নিয়ে উপস্থিত থাকবেন।
উৎসবের প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত হবে সঙ্গীত পরিবেশন, আর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে সঙ্গীত কর্মশালা, যা সকলের জন্য মুক্ত। সুরের এই মেলবন্ধনে কলকাতা শহর একটি নতুন সঙ্গীত অভিজ্ঞতা পাবে, যেখানে সুরের সঙ্গে একত্রিত হবে বিশ্বের নানা সংস্কৃতির ধারা।
শেষ দিনের অনুষ্ঠানে সমস্ত দেশের শিল্পীরা একত্রিত হয়ে পরিবেশন করবেন সুরের এক মহা সঙ্গীত। খুলে যাবে সুরের বিশ্ব, এবং শ্রোতারা শিখবে, শুনবে এবং অনুভব করবে সুরের অবিরাম ধারা। ‘সুর জাহান’ শুধু একটি সঙ্গীত উৎসব নয়, এটি একটি সুরের সম্মিলন যেখানে সারা পৃথিবী এক হয়ে যায়।
শ্রীদেবী-কন্যা খুশি কপূরের বদলে যাওয়া মুখ, নাক, ঠোঁটের গড়ন: অস্ত্রোপচারের গল্প নিজেই শেয়ার করলেন!