এফ-৩৫ না এসইউ-৫৭?
ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে নতুন মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান যুক্ত করার পরিকল্পনা ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে। মার্কিন F-35 Lightning II নাকি রাশিয়ার Su-57 Felon—কোনটি হবে দিল্লির চূড়ান্ত পছন্দ, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে, বিশেষ করে বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত ‘Aero India Show’-এর পর থেকেই। এর মধ্যেই মার্কিন যুদ্ধবিমানের পক্ষে সাফ কথা বললেন দিল্লির ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত।
এফ-৩৫-এর হয়ে প্রচারে ইসরায়েল?
ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রুভেন আজার স্পষ্টতই জানিয়েছেন যে, নয়াদিল্লির F-35 কেনা উচিত। তাঁর মতে, এই মার্কিন যুদ্ধবিমানই আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে বেশ কয়েকটি F-35 স্কোয়াড্রন রয়েছে, যা আমাদের আকাশসীমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। পশ্চিম এশিয়ায় ইসরায়েল সবসময় আকাশযুদ্ধে এগিয়ে থেকেছে, আর এর মূল কারণই হলো F-35।”
তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থানের পিছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে—
- লকহিড মার্টিন (F-35-এর নির্মাতা) ইহুদি বিনিয়োগকারীদের বিশাল অর্থ লগ্নি রয়েছে।
- ইসরায়েল ও ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চায় তেলআবিব।
- ইসরায়েল এবং আমেরিকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকেও চাপ থাকতে পারে।
Su-57-এর দিকে কি বেশি ঝুঁকবে ভারত?
যদিও ভারত এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি, বিশেষজ্ঞদের মতে রাশিয়ার Su-57 Felon-এর প্রতি ভারত বেশি আগ্রহ দেখাতে পারে। এর অন্যতম কারণ হলো ‘প্রযুক্তি হস্তান্তর’। দিল্লির দীর্ঘদিনের নীতি হলো বিদেশি যুদ্ধবিমান আমদানি করার সময় ‘Transfer of Technology’ (ToT) নিশ্চিত করা, যাতে দেশীয়ভাবে উৎপাদন করা যায়।
রাশিয়ার United Aircraft Corporation এবং Sukhoi কোম্পানি নির্মিত Su-57 দুটি ইঞ্জিন বিশিষ্ট স্টেলথ ফাইটার, যা রাডারে সহজে ধরা পড়ে না। এটি ২০২০ সাল থেকে রুশ বিমানবাহিনীতে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধেও সক্রিয় ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারত Su-57 বেছে নিলে ব্রহ্মস ও DRDO-র অস্ত্র সংযুক্ত করার সুবিধা পাবে, যা দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
F-35 বনাম Su-57: কোনটি এগিয়ে?
দুই যুদ্ধবিমানের তুলনা করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য স্পষ্ট—
| বৈশিষ্ট্য | F-35 Lightning II | Su-57 Felon |
|---|---|---|
| ইঞ্জিন | এক ইঞ্জিন | দুই ইঞ্জিন |
| সর্বোচ্চ গতি | 1,930 km/h | 2,600 km/h |
| পাল্লা | ২,৮০০ কিমি | ৩,৫০০ কিমি |
| স্টেলথ প্রযুক্তি | অত্যন্ত উন্নত | উন্নত, কিন্তু F-35-এর তুলনায় কিছুটা দুর্বল |
| নজরদারি ও হামলা | উন্নত সেন্সর ও রাডার জ্যামিং ক্ষমতা | ডগফাইটে বেশি কার্যকর |
| প্রযুক্তি হস্তান্তর | আমেরিকা রাজি নয় | রাশিয়া রাজি |
এখানে Su-57 গতি ও ডগফাইটে (Dogfight) এগিয়ে থাকলেও, F-35-এর স্টেলথ প্রযুক্তি, নজরদারি ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা অনেক বেশি। এছাড়া F-35 সহজেই ছোট রানওয়ে বা রানওয়ে ছাড়াই উল্লম্বভাবে (Vertical Landing) নামতে পারে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে বড় সুবিধা।
দাম ও প্রাপ্যতা: কোনটি সহজলভ্য?
বড় প্রশ্ন হলো—কোন বিমান ভারত দ্রুত হাতে পাবে?
- F-35-এর উত্পাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। আমেরিকা ইতিমধ্যেই ৯০০-র বেশি এই যুদ্ধবিমান তৈরি করেছে।
- Su-57 এর সংখ্যা মাত্র ২৫-৩০টি। রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায়, সরবরাহে দেরি হতে পারে।
- Su-57 তুলনামূলকভাবে সস্তা, আর রাশিয়া দাম কমানোরও প্রস্তাব দিয়েছে।
- F-35-এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেশি, এবং আমেরিকা ভারতকে সরাসরি বিক্রি করতে দ্বিধান্বিত।
ভারতের কৌশলগত সিদ্ধান্ত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই Make in India প্রকল্পের ওপর জোর দিচ্ছেন। ফলে বিদেশি অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ‘প্রযুক্তি হস্তান্তর’ শর্ত রাখছে ভারত। রাশিয়া এই বিষয়ে ইতিবাচক হলেও, আমেরিকা এখনো এ ব্যাপারে নমনীয় হয়নি।
২০২৫ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প—দুজনেই ভারত সফরে আসবেন। ধারণা করা হচ্ছে, তখনই এই প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত হবে।
ভারত কি দুটি যুদ্ধবিমানই কিনবে?
ভারতীয় বায়ুসেনার বড় সমস্যা হলো যথেষ্ট সংখ্যক যুদ্ধবিমানের অভাব। প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধির কারণে দিল্লি হয়তো দু’টি বিমানই কিছু সংখ্যক কিনতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, F-35 মূলত স্ট্র্যাটেজিক অপারেশনের জন্য, যেখানে Su-57 হবে প্রধানত আক্রমণাত্মক ও ডগফাইটিং বিমানের ভূমিকা পালনকারী। তাই ভারত শেষ পর্যন্ত দুটি বিমানকেই বেছে নেবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেবে ভারত?
যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি, তবে সামরিক ও কূটনৈতিক জল্পনা তুঙ্গে। ভারতের সামনে রয়েছে স্টেলথ ক্ষমতা বনাম গতি, প্রযুক্তি হস্তান্তর বনাম উচ্চমূল্য এবং রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক বনাম আমেরিকার আধুনিক প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের সুযোগ—এই সমস্ত ফ্যাক্টর বিবেচনা করে নয়াদিল্লি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এখন গোটা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে—ভারত এফ-৩৫-এর স্টেলথ প্রযুক্তি নাকি এসইউ-৫৭-এর যুদ্ধক্ষেত্রের শক্তি—কোনটির প্রেমে মজবে?
ইউক্রেনকে আর সামরিক সাহায্য নয়! ট্রাম্পের কড়া বার্তা, চাপে জেলেনস্কি

