রহস্যমৃত্যু ও নিয়োগ কেলেঙ্কারি!
ভারতে সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতির নজির নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এর আগেও মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারির মতো ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে। ব্যাপম কেলেঙ্কারি শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়, এটি এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র, যেখানে সাক্ষীদের একের পর এক রহস্যমৃত্যু হয়েছে, নাম জড়িয়েছে রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের।
পশ্চিমবঙ্গে এসএসসি কেলেঙ্কারি: ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেলের প্রায় ২৬ হাজার (আদতে ২৫,৭৫৩) চাকরি বাতিল করেছে। আদালত জানায়, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ ছিল। এই রায়ের ফলে রাজ্যের শিক্ষক সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে, পাশাপাশি কর্মসংস্থানের বিষয়ে এক গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের এই নিয়োগ দুর্নীতি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অতীতে মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারির ঘটনা ভারতে সরকারি নিয়োগ দুর্নীতির সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে গেছে। এই কেলেঙ্কারির প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, সেখানে জড়িত বহু ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন, যার অনেকগুলিই এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
ব্যাপম কেলেঙ্কারি: মধ্যপ্রদেশের এক ভয়াবহ দুর্নীতি
ব্যাপম (Vyapam) হল “মধ্যপ্রদেশ প্রফেশনাল এগজামিনেশন বোর্ড” (MPPEB), যা মূলত সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য পরীক্ষা পরিচালনা করত। কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকে এই সংস্থার মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতি চলতে থাকে, যার পর্দাফাঁস হয় ২০১৩ সালে।
কীভাবে এই দুর্নীতি সংঘটিত হতো? অভিযোগ ছিল, পরীক্ষার আসল প্রার্থীদের বদলে টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে পরীক্ষার্থীদের বসানো হতো। কেউ কেউ খাতার বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা রেখে দিতেন, পরে পরীক্ষা বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সেই খাতায় নিজেদের ইচ্ছামতো উত্তর লিখে দিতেন। পরীক্ষার হলে টাকার বিনিময়ে আসন বিন্যাস করা হতো, যাতে দুর্বল পরীক্ষার্থীরা মেধাবীদের পাশে বসে নকল করতে পারে। এমনকি পরবর্তীকালে উত্তরপত্রও বদলে ফেলা হতো।
সাক্ষীদের রহস্যমৃত্যু: সত্য গোপনের ষড়যন্ত্র?
ব্যাপম কেলেঙ্কারির সবচেয়ে ভয়াবহ দিক ছিল একের পর এক সাক্ষীর অস্বাভাবিক মৃত্যু। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ২৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন, আবার কেউ আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রচার করা হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যু ছিল মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন রাজ্যপাল রামনরেশ যাদবের পুত্র শৈলেশ যাদবের মৃত্যু। তিনি ব্যাপমের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ছিলেন এবং ২০১৫ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যান। এছাড়া ইনদওরের চিকিৎসক আনন্দ রাই, যিনি ব্যাপম দুর্নীতির বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন, নিয়মিত হুমকির মুখে পড়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে এক প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দেওয়া হয়।
দুর্নীতির জাল: রাজনীতি, প্রশাসন ও মাফিয়া চক্র
ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে শুধু চাকরি প্রার্থীরা নয়, উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাও জড়িত ছিলেন। ২০১৪ সালে বিজেপি নেতা তথা মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মাকে এই দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর সঙ্গে শিক্ষা দফতরের আরও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নামও উঠে আসে।
এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে গিয়ে সিবিআইও একাধিক বাধার সম্মুখীন হয়। অভিযোগ রয়েছে, যখনই তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো কোনও তথ্য উঠে এসেছে, তখনই কোনও না কোনও সাক্ষীর মৃত্যু ঘটেছে।
দুর্নীতির বিচার: সত্যের মুখোশ উন্মোচন হবে?
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ব্যাপম দুর্নীতির রায় ঘোষণা করে এবং ৬৩৪ জন চিকিৎসকের ডিগ্রি বাতিল করে দেয়। শীর্ষ আদালত জানায়, “যদি দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন বজায় রাখতে হয়, তবে কাউকেই ছাড় দেওয়া যাবে না।”
তবে, ব্যাপম কেলেঙ্কারির পূর্ণাঙ্গ সত্য আজও ধোঁয়াশায় ঢাকা। একাধিক বলিউড সিনেমা ও ওয়েব সিরিজেও এই দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই কেলেঙ্কারির মূল ষড়যন্ত্রকারীরা কতটা শাস্তি পেয়েছেন, সে বিষয়ে আজও প্রশ্ন থেকেই যায়।
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক এসএসসি দুর্নীতি কি মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারির পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? একের পর এক অনিয়ম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জড়িত থাকার অভিযোগ, এবং কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা দেখে সেই আশঙ্কাই বাড়ছে। তবে, প্রশ্ন একটাই—এই সমস্ত দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে কি? নাকি সত্যের মুখোশ একবার ফের গোপনই থেকে যাবে?
চাকরি বাতিলের ধাক্কায় শিক্ষক সঙ্কট, রাজ্যের স্কুলগুলিতে অনিশ্চয়তা