উপনির্বাচনে শাসক দল সর্বদা জয়ী
উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ ধারণা হলো, শাসকদলই সবসময় জয়ী হয়। তবে বাংলার রাজনীতির ইতিহাস বলছে, এটি সর্বদা সত্য নয়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক উপনির্বাচন পর্যন্ত শাসক দলের পরাজয়ের অনেক নজির রয়েছে। সিপিএম ও তৃণমূল উভয়ের সময়েই বাংলার বিভিন্ন উপনির্বাচনে শাসক দল পরাস্ত হয়েছে।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও বামেদের পরাজয়
২০০৬ সালে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠন হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে। বিপুল জনসমর্থনে সেসময় সিপিএম শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। কিন্তু একই সময়েই সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষি জমি অধিগ্রহণ আন্দোলন তাদের গণভিত্তিতে আঘাত হানে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রামে সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল।
এরপর, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলা পরিষদগুলিতে পরাজিত হয় বামেরা। এটি ছিল তাদের জন্য প্রথম বড় ধাক্কা। এরপর রাজ্যজুড়ে একাধিক উপনির্বাচনেও বামেরা পরাজিত হয়। জলপাইগুড়ি, বিষ্ণুপুর পশ্চিম, এমনকি কলকাতার বেলগাছিয়া কেন্দ্রেও বাম প্রার্থীরা হারেন। এইসব পরাজয় ইঙ্গিত দিয়েছিল যে বামফ্রন্ট তাদের শক্ত জমি হারাতে শুরু করেছে।
তৃণমূলের শাসনকালেও ব্যতিক্রম নয়
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসে। যদিও তাদের জয়গাথা দীর্ঘ হয়েছে, তবে তৃণমূল জমানাতেও উপনির্বাচনে হারার নজির রয়েছে।
২০১৯ সালে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূলকে হারিয়ে বিজেপি জয়ী হয়েছিল। একইভাবে, ভাটপাড়া কেন্দ্রেও তৃণমূল পরাস্ত হয়। বিশেষত সাগরদিঘির উপনির্বাচন, যেখানে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী জিতে শাসক দলকে বিব্রত করেছিল। এই হার দলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে চিড় ধরার ইঙ্গিত দেয়।
পাঁশকুড়া থেকে জঙ্গলমহল: সিপিএমের অস্বস্তি
২০০০ সালের পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিএম প্রার্থী গুরুদাস দাসগুপ্ত তৃণমূল প্রার্থী বিক্রম সরকারের কাছে পরাজিত হন। এই নির্বাচনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘পাঁশকুড়া লাইন’ বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, জঙ্গলমহলের বিনপুর কেন্দ্রেও সিপিএম হারিয়েছিল ঝাড়খণ্ড পার্টির চুনিবালা হাঁসদার কাছে। সেসময়ের সিপিএম নেতৃত্ব স্বীকার করে যে, স্থানীয় স্তরের জনবিচ্ছিন্ন নেতৃত্বই তাদের পরাজয়ের কারণ।
কেন শাসক দল হারে?
উপনির্বাচনে শাসক দলের হারের পেছনে মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো বিরোধীদের সংগঠন। যখনই কোনও এলাকায় বিরোধী দল সংগঠন শক্তিশালী করতে পেরেছে, তারা শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সফল হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাগরদিঘিতে অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সংগঠন ছিল। এই সংগঠনই তাদের জয় এনে দেয়।
অন্যদিকে, সদ্যসমাপ্ত ছয়টি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিরোধীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে কার্যত কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এক্ষেত্রে বলেন, “সংগঠন নেই। লোক নেই। তাই বিরোধীরা শুধু অভিযোগ করছে।”
উপনির্বাচনে শাসক দলের জয় সবসময় নিশ্চিত নয়, বাংলার রাজনীতি বারবার তা প্রমাণ করেছে। তবে, বিরোধী দলগুলির সাফল্যের পেছনে সুসংগঠিত প্রচার, নেতৃত্ব এবং স্থানীয় জনসমর্থন অপরিহার্য। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বিরোধীদের ব্যর্থতা এই সংগঠনের অভাবকেই তুলে ধরে। কিন্তু অতীতের নজির বলছে, এই চিত্রও বদলাতে পারে, যদি বিরোধীরা তাদের শক্তি পুনর্গঠনে সচেষ্ট হয়।