ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মামলা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নেতা ও হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির ঘটনা ঘিরে দেশজুড়ে তীব্র উত্তেজনা। এই পরিস্থিতিতে ইসকনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে ঢাকার হাইকোর্টে। চট্টগ্রাম ও রংপুরে জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
চিন্ময়কৃষ্ণ দাস, যিনি ইসকনের পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ ও সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর গ্রেফতার হন। তাঁর জামিন আবেদন ইতিমধ্যেই খারিজ হয়েছে, এবং তিনি বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছে, বন্দি অবস্থায় তাঁর ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হবে। চিন্ময়ের গ্রেফতারি এবং দেশে উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাল্টা, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইসকনকে একটি “ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
চিন্ময়ের গ্রেফতারি ও প্রতিবাদের আগুন
চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ইসকনের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেছেন, মূলত চট্টগ্রাম ও রংপুরে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন চিন্ময়ের ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা। তাঁদের দাবি, চিন্ময়ের মুক্তি এবং সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।
বিক্ষোভের সময় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে, যখন মঙ্গলবার চিন্ময়কৃষ্ণকে আদালতে আনার সময় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এবং তাঁর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে এক আইনজীবী নিহত হন এবং ৩৭ জন আহত হন, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশকর্মীও রয়েছেন। এই মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রামের আইনজীবীরা কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন।
ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি
বিক্ষোভের মাঝেই ঢাকার হাইকোর্টে ইসকনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে মামলা করা হয়। মামলায় চট্টগ্রাম ও রংপুরে জরুরি অবস্থা ঘোষণার দাবিও তোলা হয়েছে। আদালত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ইসকনকে “ধর্মীয় উগ্রপন্থা ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত” করা হয়েছে।
চিন্ময়ের গ্রেফতারির মূল কারণ হিসেবে চট্টগ্রামে একটি সমাবেশের কথা উঠে এসেছে। জানা যায়, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় চিন্ময়কৃষ্ণের নেতৃত্বে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। তাঁর ডাকে চট্টগ্রাম, শহীদ মিনার প্রভৃতি স্থানে সংখ্যালঘুদের বৃহৎ সমাবেশ হয়। ওই সমাবেশের পর স্থানীয় এক বিএনপি নেতা চিন্ময়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা করেন। এর জেরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
ধর্মীয় সংঘাত ও রাজনৈতিক পটভূমি
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও চালানো হয়েছে ভাঙচুর। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস, বারবার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
ইউনূসের দাবি, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার সুনিশ্চিত করা হবে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ প্রকাশ্যে আসায় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়ছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় সংঘাতের এই প্রেক্ষাপটে ইসকনকে নিষিদ্ধ করার মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শুরু হলে কী সিদ্ধান্ত আসবে, তা এখন দেখার বিষয়। তবে চিন্ময়ের মুক্তি এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিয়ে প্রতিবাদ যে থামবে না, তা স্পষ্ট।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মহল থেকে আসা প্রতিক্রিয়ার উপরও নজর রাখছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। ইসকনকে নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বড় বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
বাংলাদেশের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি সমাধানে সরকার, আদালত এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। তা না হলে সংঘাতের আগুন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা দেশের স্থিতিশীলতাকে গভীর সংকটে ফেলতে পারে।