Sunday, November 30, 2025

‘আমাদের তো অপরাধই ছিল অবৈধ থাকা— তাড়িয়ে দিচ্ছে তাই ফিরছি’— হাকিমপুর সীমান্তে উল্টো স্রোতের অকপট গল্প

Share

হাকিমপুর সীমান্তে উল্টো স্রোতের অকপট গল্প!

হাকিমপুর সীমান্তে গত পনেরো দিন ধরে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যা আগে কখনও দেখেনি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সাধারণত খবর আসে পাচার, চোরাচালান বা অনুপ্রবেশের। কিন্তু এবার দৃশ্য ঠিক উল্টো— শত শত মানুষ স্বেচ্ছায় লাইনে দাঁড়িয়ে বিএসএফের কাছে বলছেন,
“আমরা অনুপ্রবেশকারী। আমরা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।”

স্বরূপনগরের হাকিমপুর চেকপোস্টের সামনে এখন এক অভূতপূর্ব ভিড়। টিনের ছাউনির নিচে, রাস্তার ধারে বিছানো ত্রিপলের ওপরে বসে রয়েছে মানুষ— পরিবার, বৃদ্ধ, নাবালক, শিশু, সদ্যোজাতও। এদের মধ্যে রয়েছেন খুলনা জেলার হাবিব, যার বয়স এখনও আঠারো হয়নি। চার বছর আগে অবৈধভাবে ভারতে আসার সময় সে ছিল নাবালক। এ দেশেই বিয়ে করেছে, জন্মেছে সন্তানের। এখন সেই দুই মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে খোলা আকাশের নিচেই ঘুমোতে হচ্ছে তাকে। তাপমাত্রা সন্ধ্যার পরেই ঝপ করে নেমে যাচ্ছে, কিন্তু তবুও অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।

চেকপোস্টে মুখ চাওয়াচাওয়ি— একটাই প্রশ্নে থমথমে মুখ

জাকিরুল, সুফিয়া, হাবিব— যেই প্রশ্ন করা হোক, সবাই অকপট উত্তর দিচ্ছেন। তবে একমাত্র এক প্রশ্নেই থেমে যায় তাঁদের জবাব, মুখ ফেরে অন্যদিকে। প্রশ্নটি—
“আপনাকে এখন কেন ফিরে যেতে হচ্ছে?”

কিছুক্ষণ নীরবতার পর তারা বলে—
“সত্যি কথা বললে লজ্জা কিসের! আমাদের এখন তাড়িয়ে দিচ্ছে, তাই ফিরছি।”

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দিল্লি-সহ বিভিন্ন রাজ্যে চলা ধরপাকড়ের ভয়, সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় নজরদারির চাপ— সব মিলিয়ে অনেকেই বুঝে গিয়েছে ভারতে থাকা আর সম্ভব নয়। তাই রাতারাতি গুটিয়ে ফেলেছে সংসার। যাঁরা নিউটাউন, দমদম, বিরাটি বা খালপাড়ের বস্তিতে কাজ করতেন, তাঁরা বলছেন—
“জোগাড়ের কাজ করতাম”, “ভ্যান টানতাম”, “বাথরুম সাফ করতাম”— সবই বলছেন অস্বস্তির মাঝেও।

নাবালকের মুখে স্বীকারোক্তি— ‘আধার বানিয়েছিলাম… প্যানও’

হাবিব, যাকে আইনত এখনও নাবালক ধরা হবে, অকপটে স্বীকার করেছে—
“মিথ্যে বলব না। আধার কার্ডও করেছিলাম। একটা প্যান কার্ডও। ভোটার কার্ড হয়নি, কারণ বয়স এখনো ১৮ হয়নি।”

দু’দিন, তিন দিন, কখনও আরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা চলছে। ১০০ মিটার অন্তর বাঁশ-টিনের ছোট ছাউনি। কোথাও ১০০ জন, কোথাও ২০০ জন। সবাই চায় একটাই— নাম নথিভুক্ত করুক বিএসএফ, আর ফিরিয়ে দিক বাংলাদেশে।

চেকপোস্টের ভেতরের দৃশ্যও কম টানটান নয়। বিএসএফ জওয়ানদের উর্দিতে নাম নেই— সেলাই করা চিহ্নও বাদ। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের নাম-ঠিকানা লেখা হচ্ছে খাতায়, একে একে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সীমান্তরক্ষীদের মুখ থমথমে, পরিস্থিতি অচেনা ও বিস্ফোরক।

স্বরূপনগর অতীতে বহু কিছু দেখেছে— এমন উল্টো স্রোত কখনও নয়

১৯৭১-এর শরণার্থী ঢল দেখেছে এই এলাকা। দেখেছে কাঁটাতারের ওপারে রাজনৈতিক পালাবদল, দেখেছে চোরাচালানের উত্থান-পতন। কিন্তু এই প্রথম দেখা যাচ্ছে এ ধরনের ‘ফিরতি অনুপ্রবেশ’— যেখানে মানুষ নিজেরাই বলছেন তাঁরা অবৈধ, নিজেরাই ফিরে যেতে চাইছেন সীমান্ত পার হয়ে।

শেষ কথা— এই বাস্তবতা শুধু পরিসংখ্যান নয়, মানুষজন

খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর— নানা জেলা থেকে আসা মানুষজন এখন বলছেন,
“আমরা অপরাধী নই, কিন্তু অবৈধভাবে ছিলাম— তাই ফিরছি। আর কোনও উপায় নেই।”

হাকিমপুর সীমান্তের এই দৃশ্যটাই এখন বাংলাদেশের দিকে ফিরতে চাওয়া হাজার মানুষের অকপট গল্প— লজ্জা নয়, শুধু ভয় আর অনিশ্চয়তার স্রোত।

Read more

Local News