আচমকা ঘুম! এক মুহূর্তেই ‘বন্ধ’ হয়ে যায় মস্তিষ্ক
আমরা সাধারণত মনে করি ঘুম ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে—চোখ ভারী হয়, ভাবনাচিন্তা স্তিমিত হয়, শরীর আলগা হয়ে আসে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানালেন, এই ধারণা বেশির ভাগটাই ভুল। মানুষের ঘুম আসা আসলে এক নাটকীয়, প্রায় আকস্মিক ঘটনা—এক মুহূর্তে জেগে থাকা থেকে সোজা ঘুমের গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া।
নতুন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঘুমে ঢলে পড়া ধীরগতির রূপান্তর নয়, বরং ক্ষণিকের এক ‘সুইচ অফ মোমেন্ট’—যখন মস্তিষ্ক হঠাৎই কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এই আবিষ্কার ঘুম-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান থেকে শুরু করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আকস্মিক ঘুমিয়ে পড়া প্রতিরোধ—সব ক্ষেত্রেই বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
❖ ঘুম আসে ধীরে নয়, আচমকা—নতুন তথ্য জানালেন বিজ্ঞানীরা
স্নায়ুবিজ্ঞানী নির গ্রসম্যান এবং তাঁর সহ-গবেষকেরা ইইজি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখেছেন, মস্তিষ্কের কার্যকলাপ একটি নির্দিষ্ট বিন্দু পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। তারপর হঠাৎই সেটি নিস্তব্ধ হয়ে যায়—এক মুহূর্তে। সেই মুহূর্ত কাটতেই মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে।
তাঁদের ভাষায়,
“জাগ্রত অবস্থা ও ঘুম—এই দুইয়ের সীমানা তৈরি করে একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু নাটকীয় বিন্দু।”
এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘নেচার নিউরোসায়েন্স’-এ।
❖ এই আবিষ্কার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
✓ ঘুম না-আসা রোগীদের চিকিৎসায় নতুন দিশা
যাঁদের অনিদ্রা বা দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের চিকিৎসায় কার্যকর পদ্ধতি তৈরি হতে পারে এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে।
✓ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ‘মাইক্রো-স্লিপ’ প্রতিরোধ
রাস্তার মোড়ে গাড়ি চালাতে চালাতেই আচমকা ঘুমিয়ে পড়ে অনেক চালক—এতে প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে।
নতুন গবেষণা বলে দিচ্ছে, ঠিক কখন মস্তিষ্ক ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে, তা আগেভাগে শনাক্ত করার ব্যবস্থা ভবিষ্যতে তৈরি হওয়া সম্ভব।
✓ দুঃস্বপ্ন, অতিরিক্ত ঘুম, হঠাৎ তন্দ্রা—সবই বুঝতে সাহায্য করবে
❖ মস্তিষ্ক কেন আচমকা ‘ঘুমের সুইচ’ টিপে দেয়?
মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ নিউরোন আছে, যাদের বলা হয় ‘নিউক্লেই’।
এদের একটা অংশ জাগিয়ে রাখে, আরেক অংশ ঘুমে তলিয়ে যেতে সাহায্য করে।
ঘুমে প্রবেশের সময়—
- জাগিয়ে রাখা নিউক্লেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়
- ঘুম-পাড়ানো নিউক্লেই সক্রিয় হয়ে ওঠে
- সেই মুহূর্তেই মস্তিষ্ক কাজ বন্ধ করে দেয়
- এবং মানুষ কোন প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে
এটি কোনও ধীর রূপান্তর নয়, বরং ঠিক সুইচের মতো—ON থেকে OFF।
❖ মস্তিষ্কের কোন অংশ আগে ঘুমিয়ে পড়ে?
গবেষণায় আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে—
১. ফ্রন্টাল কর্টেক্স আগে ঘুমায়
এই অংশ দায়িত্বে থাকে—
- ভাবনা
- যুক্তি
- স্মরণশক্তি
- আবেগ তৈরি
ফলে প্রথমেই এসব ক্ষমতা স্তিমিত হতে শুরু করে।
২. তার পরে ঘুমের দেশে যায় অসিপিটাল কর্টেক্স
এটি চাক্ষুষ তথ্য প্রক্রিয়া করে।
এই কারণেই অনেকের চোখে ঘুম আসতে সময় লাগে, যদিও চিন্তাশক্তি আগে থেকেই ‘স্লো’।
এই ভিন্নগতির ঘুমের প্রবেশদ্বারই হয়তো ব্যাখ্যা দেয়—
কেন কেউ কেউ চোখ আধবোজা অবস্থায়ও ভাবতে থাকে, আবার কেউ চিন্তা বন্ধ করতেই তন্দ্রা নেমে আসে।
❖ ভবিষ্যতে কী উপকার মিলতে পারে?
✦ অনিদ্রার আধুনিক চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি
✦ ঘুম নিয়ে সমস্যা থাকা রোগীদের জন্য নিরাপদ থেরাপি
✦ চালক, পাইলট, মেশিন অপারেটরের মতো ঝুঁকির পেশায় ‘ঘুম সতর্কতা প্রযুক্তি’ তৈরি
✦ মানসিক চাপ বা অবসাদজনিত ঘুম সমস্যার নির্ণয়ে প্রভূত উন্নতি
শেষকথা
ঘুম আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু তার আগমনের মুহূর্ত এতদিন রহস্যই ছিল।
এ বার বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিলেন—
ঘুম আসে ধীরে নয়, আচমকা।
এক মুহূর্তেই মস্তিষ্কের আলো নিভে যায়, আর আমরা পা রাখি স্বপ্নের দুনিয়ায়।

