Tuesday, November 11, 2025

৭০০ শুটারের বিশাল বাহিনী: সলমন খানকে খুন করতে কেন চায় লরেন্স বিশ্নোই?

Share

সলমন খানকে

বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা সলমন খান, গত কয়েক বছর ধরে বারবার খুনের হুমকির শিকার হয়েছেন। এই হুমকি এসেছে লরেন্স বিশ্নোই গ্যাং থেকে, যার সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৭০০-এরও বেশি। এই দুষ্কৃতী গ্যাং কেবল সলমনকেই নয়, আরও বহু খুনের ঘটনায় জড়িত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই গ্যাং বারবার সলমনকে টার্গেট করছে? এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, তা শুধু ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নয়, বরং ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সলমন খানকে

লরেন্স বিশ্নোইয়ের অপরাধ জগতের উত্থান

লরেন্স বিশ্নোই পঞ্জাবে ১৯৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আবোহারে বেড়ে ওঠেন এবং পড়াশোনার জন্য চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে অপরাধমূলক কার্যকলাপে সম্পৃক্ত হন। ২০১১ সালে তিনি পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে যোগ দেন, আর সেখান থেকেই তাঁর অপরাধজগতের যাত্রা শুরু। এই সময়ে তাঁর পরিচয় হয় সতীনদরজিৎ সিংহ ওরফে গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে বিশ্নোইয়ের প্রধান সহযোগী হয়ে ওঠেন।

ব্রারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর বিশ্নোই ক্রমশ ছাত্র রাজনীতি থেকে সরে আসেন এবং অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন। প্রথমে তোলাবাজি এবং পরে মাদক পাচার, মদের কালোবাজারি এবং সুপারি কিলিং (টাকা নিয়ে খুন) এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর দলবল ধীরে ধীরে পঞ্জাবসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে। আজ তাঁর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ৭০০, যার মধ্যে ৩০০ শুটার শুধুমাত্র পঞ্জাবেই সক্রিয় রয়েছে। তাঁর দলের অপরাধমূলক কার্যকলাপ এতটাই বিস্তৃত যে, বর্তমানে ১১টি রাজ্যের পুলিশ তাঁকে খুঁজছে।

সলমন খানের সঙ্গে শত্রুতা: কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা মামলা

লরেন্স বিশ্নোই গ্যাংয়ের প্রধান লক্ষ্য কেন সলমন খান? এর উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯৮ সালে। সলমন তখন রাজস্থানের জোধপুরে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ ছবির শুটিং করছিলেন। সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার অভিযোগ ওঠে। বিশ্নোই সম্প্রদায় কৃষ্ণসার হরিণকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করে এবং এই হত্যাকাণ্ড তাঁদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত হানে।

এই ঘটনার পরই লরেন্স বিশ্নোই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তিনি সলমনকে খুন করবেন। ২০১৮ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হলে তিনি আদালতে বলেন, “আমরা সলমন খানকে হত্যা করব। আমরা ব্যবস্থা নিলেই সবাই জানতে পারবে।” এর পর থেকেই বিশ্নোই গ্যাং সলমনের পেছনে লেগে রয়েছে। ২০১৮ সালে সম্পথ নেহরা নামে এক সুপারি কিলারকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি সলমনের বাড়ি রেকি করছিলেন। পুলিশের ধারণা, এই সুপারি কিলিংয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন লরেন্স বিশ্নোই নিজেই।

সিধু মুসে ওয়ালা এবং অন্যান্য খুনের সঙ্গে যুক্ততা

লরেন্স বিশ্নোই গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কার্যকলাপ শুধু সলমন খানকে হুমকি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০২২ সালের ২৯ মে পঞ্জাবের মানসাতে জনপ্রিয় র‌্যাপার ও কংগ্রেস নেতা সিধু মুসে ওয়ালাকে গুলিতে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও লরেন্স বিশ্নোইয়ের নাম উঠে আসে। যদিও খুনের সময় বিশ্নোই তিহার জেলে বন্দি ছিলেন, তবে তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন যে, জেল থেকেই তিনি তাঁর গ্যাং পরিচালনা করছেন।

জেলে থেকেও বিশ্নোইয়ের গ্যাং একাধিক খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ২০২৩ সালে তাঁর গ্যাংয়ের সদস্যরা সলমনের বান্দ্রার বাড়ির সামনে গুলি চালায়। যদিও এতে সলমনের কোনও ক্ষতি হয়নি, তবে ঘটনাটি আবারও সলমনের জীবনের ঝুঁকির দিকটি সামনে আনে। এছাড়াও, বিশ্নোই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণপন্থী নেতা সুখদেব সিং গোগামেডি এবং পঞ্জাবি গায়ক গিপ্পি গ্রেওয়ালের বাড়ির সামনে গুলি চালানোর ঘটনা।

বিশ্নোই গ্যাংয়ের আধুনিক রিক্রুটমেন্ট এবং সম্প্রসারণ

বিশ্নোই গ্যাং শুধুমাত্র অপরাধমূলক কার্যকলাপেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের সম্প্রসারণ কৌশলও বেশ সুসংগঠিত। সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিশ্নোই গ্যাং যুবকদের দলে টানার সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। ফেসবুক, ইউটিউব, এবং ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে তারা নিজেদের কার্যকলাপ প্রচার করে এবং অপরাধমূলক মনোভাবাপন্ন যুবকদের আকৃষ্ট করে। এই পদ্ধতিতে বহু যুবক গ্যাংয়ে যোগ দিচ্ছেন বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।

এছাড়া, পঞ্জাবের যুবকদের জন্য কানাডা পাড়ি দেওয়ার স্বপ্নকেও কাজে লাগাচ্ছে বিশ্নোই গ্যাং। অনেক পঞ্জাবি যুবক কানাডায় যেতে চান, কিন্তু অর্থের অভাবে তা করতে পারেন না। বিশ্নোই গ্যাং তাদের লোভ দেখিয়ে তোলাবাজি, খুন, এবং মাদক পাচারের মতো অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করে। একবার এই অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের আর ফিরে আসার উপায় থাকে না।

লরেন্স বিশ্নোইয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ

লরেন্স বিশ্নোই গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং তাদের খুনের তালিকা ক্রমশ বাড়ছে। পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া খালিস্তানি জঙ্গি হরবিন্দর সিং রিন্ডার সঙ্গে বিশ্নোই গ্যাংয়ের সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করেছে এনআইএ। আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, বিশ্নোই গ্যাং পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর থেকে অর্থ পাচ্ছে, যা ভারতীয় গোয়েন্দাদের জন্য চিন্তার বিষয়।

আজ লরেন্স বিশ্নোইয়ের গ্যাং কেবল উত্তর ভারতেই নয়, সারা ভারত জুড়েই একটি বিশাল ত্রাসের নাম। তাঁর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে, ১১টি রাজ্যের পুলিশ তাঁকে খুঁজছে। তবে সলমন খানের জীবন নিয়ে বিশ্নোই গ্যাংয়ের হুমকি এখনও বহাল, এবং তদন্তকারীরা এখনো জানার চেষ্টা করছেন যে, কীভাবে এই গ্যাং জেলের ভিতর থেকেও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

উপসংহার

লরেন্স বিশ্নোই এবং তাঁর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কার্যকলাপ ভারতজুড়ে একটি বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্নোই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগ এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার মিশ্রণ থেকে সলমন খানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্নোই গ্যাংয়ের ৭০০ শুটার এবং তাঁদের সুসংগঠিত অপরাধমূলক নেটওয়ার্ক ভারতের বিভিন্ন অংশে একটি বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Read more

Local News